মেয়র পদের শপথ নিয়েই হাতে পেয়েছেন আলাদিনের চেরাগ!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : অমিতাভ বোস। পেশায় ভাঙারি ব্যবসায়ী। থাকতেন ভাড়া বাড়িতে। আওয়ামী লীগের পঞ্চম সারির নেতা। এ অবস্থায় গত পৌর নির্বাচনে বাগিয়ে নেন মেয়র পদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নৌকার টিকিট। ভাগ্য খুলে যায় তার। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শপথ নিয়েই যেন হাতে পেয়েছেন আলাদিনের চেরাগ।

মাস ছয় না পেরোতেই বানিয়েছেন ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চারতলা আলিশান বাড়ি। নাম দিয়েছেন শুভ্রালয়। শুরু হয় ‘শুভ্রালয়’ ঘিরে অনুগতদের আনাগোনা। টেন্ডারবাজি, তোলাবাজি, জমি দখল তার নেশা। তোলাবাজি হয় ইজারাবিহীন শ্রম বিক্রির হাটে, বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাথ, অবৈধ স্থাপনা থেকেও। টেন্ডারে কমপক্ষে ৫ শতাংশ তার জন্য নির্ধারিত। কখনো কখনো আরও বেশি। এ জন্য অনেকে তাকে বলে থাকেন ‘মিস্টার ফাইভ পারসেন্ট’। এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি বাহিনীও গড়ে তুলেছেন মেয়র। তাদের নিয়ে হোটেল রাজস্থানে আড্ডা বসান নিয়মিত। চলে মদের আসর। ফরিদপুরের মানুষ বলছেন, তিনি আলোচিত-সমালোচিত বরকত-রুবেলের শূন্যস্থান পূরণ করেছেন। অন্যদিকে, পৌরভবনে তৈরি করেছেন আতঙ্ক। ছাঁটাই আর বদলি আতঙ্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নিয়োগ বাণিজ্য ওপেন সিক্রেট। গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসিয়েছেন নিজস্ব লোক। দেদারছে চলছে ঘুষ বাণিজ্য। বরাদ্দের বিপরীতে নিম্নমানের কাজ আর নানা অজুহাতে পৌরবাসীর কাছ থেকে আদায় করছেন অতিরিক্ত অর্থ। তছরুপ করছেন পৌরফান্ড। এসব নিয়ে সম্প্রতি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও পড়েছে। অভিযোগের বিষয়ে সরজমিন অনুসন্ধান চালিয়েছে মানবজমিন।

জানা যায়, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ভাঙারি ব্যবসায়ী অমিতাভ বোস। ২০২০ সালের ১০ই ডিসেম্বর নির্বাচনে তিনি নৌকার টিকিটে ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জয়লাভ করে ২০২১ সালের ৫ই জানুয়ারি শপথ নেন। এরপরই পুরনো চেহারা বদলে ফেলেন তিনি। ভাড়া বাড়ি থেকে ওঠেন শহরের গোয়ালচামট এলাকায় সদ্য নির্মিত আলিশান বাড়িতে। একক আধিপত্য নিতে পৌরভবনে নামেন অ্যাকশনে। ৯ই ফেব্রুয়ারি বদলি করেন দীর্ঘদিনের হিসাবরক্ষক মো. ফজলুল করিম আলালকে। তার স্থলাভিষিক্ত করেন একান্ত অনুগত গোবিন্দ সাহাকে। মেয়রের অর্থকড়ি তিনিই মেইনটেইন করেন। একের পর এক রদবদল চলতে থাকে পৌরভবনে। আগের মেয়রের সময়ের মাস্টাররোলে কর্মরতদের ছাঁটাই করেন। নিজের বলয়ের বাইরের লোকদের ফিল্ডে পাঠিয়ে দেন। নতুন করে মাস্টাররোলে নিয়োগের হিড়িক চলে। তাদের চাকরি স্থায়ী করতে ইতিমধ্যে তোড়জোড় শুরু করেছেন মেয়র। এসব নিয়োগে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠেছে। এদিকে অনুগতদের দিয়ে পৌরভবনে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন তিনি। ঘুষ বাণিজ্যে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছেন পৌরবাসী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৌরসভা থেকে ৫০ টাকার জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে লাগে ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ- শব্দ করলে চলে হুমকি-ধামকি। ভয়ে তাই মুখ খোলার সাহস নেই কারও। গ্রাহকের হোল্ডিং নাম্বার দিতে নেয়া হয় ৩০০ টাকা, যার কোনো ফি নেয়ারই নিয়ম নেই। মেয়রের নিজস্ব লোক বসানো হয়েছে ডিজিটাল সেন্টারেও।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মেয়র অমিতাভ বোসের সাম্রাজ্য সামলাতে রয়েছে অনুগত বাহিনী। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে পৌরভবনের সিদ্ধান্ত নিতেও রয়েছে তাদের ভূমিকা। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কাউন্সিলরদের কোনো উপায় থাকে না। এই বাহিনীর অন্যতম খায়রুদ্দিন মিরাজ। তিনি অমিতাভের ডান হাত। অভিযোগ রয়েছে, তিনিই দেখাশোনা করেন অমিতাভের সাম্রাজ্য। অবৈধ টাকা-পয়সা কালেকশনের দায়িত্বও তার। এ ছাড়া রয়েছেন দেলোয়ার, মাহবুবুর রহমান, সুবল, টিটু, ওহিদুজ্জামান দিপু। এদের মধ্যে ওহিদুজ্জামান দিপুর দায়িত্ব ইজারাবিহীন লেবার হাট থেকে চাঁদা তোলা। প্রতি লেবারের কাছ থেকে দৈনিক ১০ টাকা করে তোলেন তিনি। কোনো লেবার কাজ না পেলেও চাঁদা বাধ্যতামূলক। এই চাঁদার মধ্যে ৮০০ টাকা চলে যায় খায়রুদ্দিন মিরাজের কাছে। দিপুর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগও রয়েছে। আর এসবই চলে মেয়র অমিতাভ বোসের শেল্টারে।

সম্প্রতি অমিতাভের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ টেপাখোলা গরুর হাটের টেন্ডারে অনিয়ম। দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এ হাটে এবার টেন্ডার দেয়া হয়েছে মাত্র ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩০ টাকায়। গতবার করোনাকালীন সময়েও এ হাটের টেন্ডার ছিল ৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। অর্থাৎ এবার প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা কমে টেন্ডার দেয়া হয়েছে সালেহ আহমেদ নামে এক ব্যক্তিকে। অনেকে বলছেন, এবারের টেন্ডার পাওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মূলত গতবারের ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ বলয়ের সিদ্দিক এন্টারপ্রাইজের ডামি। তাছাড়া এই বিপুল পরিমাণ টেন্ডার নেয়ার মতো যথেষ্ট অর্থকড়িও নেই সালেহ আহমেদের।

তবে এ ব্যাপারে মেয়র বলছেন, নিয়ম মেনেই টেন্ডার দেয়া হয়েছে। তিনবারের টেন্ডারের মূল্য গড় করে এইবার বিড করা হয়েছে। তবে নিয়মানুযায়ী, আগের বছরের চেয়ে কম মূল্য হলেও অন্তত তিনবার টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেয়ার নিয়ম। তাতেও দাম না ওঠলে বিগত তিন বছরের গড় করতে হবে। জনশ্রুতি রয়েছে, এখান থেকে অন্তত কোটি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। একইসঙ্গে তার অনুগত কাউন্সিলরদেরও একটা অংশ দিয়েছেন।

মেয়র তছরুপ করছেন পৌরফান্ড- এমন অভিযোগ ওঠছে হরহামেশাই। ‘এ’ ক্লাস পৌরসভার মেয়র হিসেবে অমিতাভ বোস দুর্যোগকালীন মুহূর্তে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারেন। তার মেয়াদকালে এখন পর্যন্ত পৌরবাসী তেমন কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হননি। কিন্তু ইতিমধ্যে ওই ফান্ড থেকে তিন কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাউন্সিলর জানান, প্রতিবছর টিআর, কাবিখা নিয়ে মিটিং হয়। কিন্তু এবছর কোনো মিটিং হয়নি। টেন্ডারের বিষয়ে কখনো কাউন্সিলরদের জানানো হয় না, এমনকি নোটিশও দেয়া হয় না। ওই কাউন্সিলর বলেন, পৌরভবনে কাউন্সিলরদের বিকল্প হিসেবে মেয়রের লোকজন নিয়ে নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সভাগুলোতে তাদের মতামতই প্রাধান্য পায়। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে বৃক্ষরোপণের জন্য ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও দায়সারাভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিন লাখ টাকার বেশি এ প্রকল্পে খরচ হয়নি বলে অনেকের মন্তব্য। সরজমিনও এমন অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। তবে মেয়র অমিতাভ বোস জানান, বৃক্ষরোপণের জন্য তিনি কোনো ফান্ড পাননি। পৌরসভার ট্যাক্স হিয়ারিংয়ে মেয়রের থাকার কথা থাকলেও তিনি এতে অংশ নেন না।

মেয়রের বাড়ির কাছেই শত্রু সম্পত্তি একটি বিশালাকারের পুকুর তিনি মন্দিরের নামে ভরাট করেছেন। পরে ওই জমি মন্দিরে না দিয়ে প্লট আকারে বিক্রি করে তাদের নামে ভুয়া কাগজপত্র করা হয়েছে। এখান থেকে মেয়র কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে মেয়র বলেন, জমিটি শত্রু সম্পত্তি নয়, ব্যক্তি মালিকানাধীন। তাদের নামে সিএস, আরএস দলিল রয়েছে। এখানে তার কোনো হাত নেই। এ ছাড়া পৌরসভার ব্রহ্ম সমাজ সড়ক মেরামতে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও কাজ করা হয়েছে অত্যন্ত নিম্নমানের। এ কাজ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা মেয়রের পকেটে ঢুকেছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

মেয়র অমিতাভ শহরের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ স্থাপনার অনুমোদন দিয়ে মাসোহারা, বাড়ি তৈরির অনুমোদনে নির্ধারিত ফি’র বাইরে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করেন। এক্ষেত্রে লোকাল কাউন্সিলরকে তোয়াক্কা করা হয় না। সরকারি আদেশ অমান্য করে অটোরিকশার লাইসেন্স প্রদান করেছেন তিনি। লাইসেন্স প্রতি ২৯০০ টাকা করে আদায় করছেন। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে তার অটোরিকশা জব্দ করে ফেলে রাখা হয়। এতে এক সপ্তাহের মধ্যেই ৩০-৩৫ হাজার টাকা দামের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষতি থেকে বাঁচতে চাঁদা দেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না অটোরিকশার মালিক-চালকদের। ফরিদপুর সিটি করপোরেশন না হওয়া সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন দাবি করে উচ্চমূল্যে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। এখান থেকে মেয়র বিপুল অঙ্কের কমিশন আদায় করেন। ফরিদপুর মেডিকেলের টেন্ডারবাজিতেও জড়িত মেয়র অমিতাভ।

অভিযোগ রয়েছে, পৌর কর্মচারীদের তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে থাকেন। শহরের গোয়ালচামট এলাকায় চারতলা যে আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন তাতেও পৌর কর্মচারীদের কাজে লাগিয়েছেন। এমনকি পৌরসভার সরঞ্জাম ব্যবহার করেছেন বিনা পয়সায়।

এদিকে, গত ২৭শে মার্চ পৌর মেয়র অমিতাভ বোসের দুর্নীতি-অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরে এলজিইডি মন্ত্রী বরাবর একটি অভিযোগ দিয়েছেন শংকর নামে এক ব্যক্তি। এ অভিযোগের অনুলিপি দুদকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দেয়া হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, মেয়েরের কার্যকলাপে অতিষ্ঠ ফরিদপুরের মানুষ। তার সীমাহীন দুর্নীতি, সরকারি অর্থ লোপাট বিগত দিনের যেকোনো মেয়রকে হার মানিয়েছে। ওই অভিযোগপত্রে বলা হয়- কোনো বিল্ডিং তৈরির অনুমোদন দিতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ৫-৬ লাখ টাকা করে নেন। সরকারি তহবিল থেকে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অর্থ উত্তোলন করে সন্ত্রাসী বাহিনী লালন পালন করেন। প্রতিরাতে হোটেল রাজস্থানে সন্ত্রাসীদের নিয়ে মদ্যপানে বিভোর হয়ে থাকেন এবং বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ফোনে হুমকি প্রদান করেন। সম্প্রতি তার কথায় সম্মতি না দেয়ায় জেলার পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতিকে অপসারণ করে সন্ত্রাসী পাঠিয়ে হেনস্তা করা হয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মেয়র অমিতাভ বোস বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, বিগত মেয়রের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পৌরসভার দায়িত্ব নিয়েছি। গত এক বছরে তেমন কোনো প্রকল্পও পাননি দাবি করে তিনি বলেন, দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। বদলি-নিয়োগের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি আমার মতো করে পৌরসভা চালাতে চাই। আমার আগে যিনি মেয়র ছিলেন তিনি একটানা ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। সবই তার লোকজন। তিনি টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেন অমিতাভ। বলেন, তারা থাকলে আমি পৌরসভা চালাতে পারবো না। এখানে নিয়মের বাইরে কিছুই করিনি। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করে বলেন, এখনো ব্যাংকে আমার ৫০ লাখ টাকা সিসি লোন রয়েছে। গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে নির্বাচন করেছেন বলেও দাবি তার।

 

সূত্র: মানবজমিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button