বিচার ব্যবস্থার প্রতি কি মানুষের আস্থা কমছে?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের স্বজনরা বলছেন, আমরা ‘বিচার চাই না’৷ কেন তারা বিচার চান না? বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, নাকি বিচারের খরচ জোগাতে না পারা? নাকি অন্য কিছু?
গত ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুর আমতলা রেলগেট এলাকায় বান্ধবীর সঙ্গে রিকশায় থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতি। আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে মারতে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে সেই গুলি গিয়ে লাগে প্রীতির শরীরেও। মেয়ের এমন মৃত্যুর পর তার বাবা জামাল উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখলাম। কার শাস্তি চাইব? বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব?”
শনিবারএকই কথা বললেন জামাল উদ্দিন। কেন বিচার চান না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বিচার হলে কি আমার মেয়ে ফিরে আসবে? আসবে না। আমি খুব ছোট একটা চাকরি করি। অনেক কষ্ট করে চলি। এখন বিচার চাইতে গেলে যে খরচ হবে সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা যে একেবারে নেই তা নয়? কিন্তু বিচার হতে হতে তো অনেক বছর লেগে যাবে, এতদিন আদালতে দৌড়ানোর মতো অবস্থা আমার নেই। ফলে আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রেখেছি।”
একইভাবে নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হাসান। ছেলের মৃত্যুর পর মো. নাদিম বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী লাভ? কার কাছে বিচার চাইব?”
মো. নাদিম বলেন, ‘‘আমি গরীব মানুষ। আমি বিচার চাই না।” আপনার পক্ষে তো আপনার ভাই মো. শরীফ বাদি হয়ে মামলা করেছেন? আপনি কি এই মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না? জবাবে জনাব নাদিম বলেন, ‘‘না, আমি এই মামলার বিষয়ে কিছু জানি না। কেউ আমার অনুমতি নেয়নি। পুলিশ আমাকে মামলা করতে বলেছিল, আমি রাজি হইনি। আমার এমনিতেই সংসার চলে না, বিচার চেয়ে কি হবে?”
সাম্প্রতিক সময়ের শুধু এই দু’টি ঘটনাই নয়, এর আগেও অনেকেই বলেছেন বিচার চান না। এর আগে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের হত্যাকাণ্ডের পর তার বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকও বলেছিলেন, ‘তিনি বিচার চান না।’ এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনাও হয়েছিল। সবশেষ তিনি একই অবস্থানে ছিলেন।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, ‘‘আমাদের বিচার ব্যবস্থার উপর তাদের আস্থা নেই বলেই তারা বিচার চান না। এখানে বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতা আছে, বিচারের নামে প্রহসন আছে, সেজন্য তারা বিচার চায় না। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অনেক বড় বড় বুলি দেন, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। আমরা উন্নয়নের রোল মডেল বলছি, শহরে ফ্লাইওয়ার হলে গ্রামের মানুষের কোন উপকার হয়? ২ হাজার কোটি টাকা স্যাটেলাইট করলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কি উপকার হয়? আসলে আমাদের রাষ্ট্রটা পুজিবাদী রাষ্ট্র, সে হিসেবেই তারা চলছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা তারা ভাবে না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘‘আমি অনেকদিন ধরেই বলে আসছি আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম যেটা সেটা দিয়ে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবো না। পুলিশ, কোর্ট, প্রিজন ও প্রসিকিউশন এই চারটা জিনিস নিয়েই তো ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম। এর মধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তাদের মধ্যে একটু হলে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু কোর্ট, প্রিজন এবং প্রসিকিউশন একেবারেই সেকেলে রয়ে গেছে। আসলে কলোনিয়াল সেট আপ থেকে তারা এখনও বের হতে পারেনি। ব্রিটিশরা এগুলো তৈরি করেছিল তো মানুষকে শোষণ ও শায়েস্তা করার জন্য। এখন স্বাধীন দেশে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তন দরকার। এই ধরনের বক্তব্য আমাদের উদ্বিগ্ন করে। এগুলো কিন্তু কোন আর্টিফিয়াল বক্তব্য না। একেবারেই সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ এই ধরনের কথা বলছেন। ফলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।”
তবে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা উঠে গেছে বিষয়টি এমন করে ভাবতে রাজি নন ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ‘‘গত বছর বাদে আগের ১০ বছর ধরলে প্রতি বছর সাড়ে তিন থেকে ৪ হাজার হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। ১০ বছরে তাহলে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এই ধরনের কথা বলেছেন কতজন? তিনজন বা চারজন। যদিও একজনও এমন কথা বলুক সেটা আমরা চাই না। তারপরও এই সংখ্যাটা খুবই কম। মাস তিনেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ৪০টা মামলা ঘেঁটে দেখেছেন বিচারিক আদালতে একটা মামলা শেষ হতে গড়ে সাড়ে ৪ বছর লেগেছে। আর উচ্চ আদালতে লাগে আরও সাড়ে ৫ বছর। সবমিলিয়ে একটা মামলার নিষ্পত্তি হতে ১০ বছর লাগলেও সারা বিশ্বের হিসেবে এটা বেশি সময় না। উন্নত দেশগুলোতেও এর কাছাকাছি সময় লাগে। আবার দেখেন আদালতে সাক্ষীদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষী না আসলে বিচারক তো তাকে হাজির করতে পারেন না। এটা পুলিশকেই করতে হয়। ফলে বিচারক দিনের পর দিন পেছাতে বাধ্য হন। সবাই তো বলেন, মামলা বিলম্বিত হয়, কিন্তু কেন হয় সেটা তো আর কেউ দেখে না। পুলিশ সাক্ষী হাজির করে না বলেই মূলত বিলম্ব হয়।”
বিচার ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা নেই কেন? জবাবে জনাব মালিক বলেন, ‘‘নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পুরোপুরি আলাদা না হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে না কারণ কিছুটা হলেও যেন নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিচার বিভাগের উপর থাকে। জনগণ হয়ত বুঝতে পারছে, যে কারণে আস্থা বাড়ছে না।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে