দ্রব্যমূল্যের চাপে কাঁটছাট হচ্ছে খাদ্য তালিকা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গত এক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে৷ এই বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্য তালিকা কাঁটছাট করছে অনেক পরিবার।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। খাদ্য তালিকা থেকে তারা বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংস।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম যা বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে বাংলাদেশের বাজারে। সম্প্রতি কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় এসেছেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ এতটাই যে, তারা চাইলে পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেন। এখন বাজার যারা মনিটরিং করছেন তাদের কাছে হয়ত পর্যাপ্ত তথ্য থাকছে না। এখানে মনিটরিংটা আরও জোরদার হওয়া দরকার।”

শেওড়াপাড়া বাজারে মাছ বিক্রি করেন মোসলেম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘‘তেলাপিয়া বা পাঙ্গাস মাছের দামও কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। এক কেজি ওজনের রুই আগে ২০০ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাবদা, টেংড়া মাছের দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে। এখন এক কেজি ওজনের একটা ইলিশ এক হাজার ৬০০ টাকার কমে পাওয়া যায় না। ফলে সব মাছের দামই গড়ে অন্তত ৫০ টাকা বেড়েছে৷ দাম বৃদ্ধির এই চিত্র গত ১৫ দিনের।”

একই বাজারে মাংস ব্যবসায়ী আমীর হোসেন বলেন, ‘‘গরুর মাংসের দাম গত কয়েকদিনে খুব একটা বাড়েনি। এখন ৬৮০-৬৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস বিক্রি করছি ৯৫০ টাকা কেজি দরে। কিন্তু মাংসের দাম এত বেড়েছে যে আগে যিনি ৪ কেজি কিনতেন, এখন তিনি ২ কেজিও নিচ্ছেন না। এক বছর আগেও করোনার মধ্যে প্রতিদিন অন্তত ৫০ কেজি মাংস বিক্রি করেছি। আর এখন ২০-২৫ কেজিও বিক্রি করতে পারি না।” মানুষের কেনার সামর্থ্য কমে গেছে বলে মনে করেন আমীর হোসেন।

শেওড়াপাড়া বাজারে শনিবার বাজার করতে এসেছেন গৃহবধূ তাহমিনা আক্তার। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সঙ্গে আলাপকালে এই নারী জানালেন, ‘‘বাজারের হিসাব এখন আর মিলছে না। আমাদের ৫ জনের সংসার। স্বামী-স্ত্রী, দুই সন্তান আর শ্বাশুড়ি। খাওয়া বাবদ প্রতি মাসে আমরা সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারি। পাঙ্গাস মাছ আমরা আগে কখনও খাইনি। কেউ পছন্দও করে না। শুধু খরচ বাঁচাতে গত তিন মাসে বহুবার পাঙ্গাস মাছ খেয়েছি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেলাপিয়াও। বাচ্চারা পছন্দ করে না, কিন্তু কি করা? গত এক মাসে একবারও মাংস কিনিনি। কারণ মাংস কিনতে গেলে অন্যান্য জিনিস কেনা কঠিন। সত্যি বলতে কি, মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামলাতে আমরা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। বাজারে চাল, আটা, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে আমরা মাছ-মাংসে কাঁটছাট করছি।”

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বাজারের ৩২ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব রাখে৷ সংস্থাটির গত এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের ব্যবধানে বাজারে ৩২ খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ১৯টির দাম। কমেছে শুধু একটি পণ্যের দাম৷ স্থিতিশীল রয়েছে ১২টির।

টিসিবি বলছে, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন, পাম অয়েল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, তেজপাতা, গুড়া দুধ, চিনি ও ডিমের দাম বেড়েছে। বাজারে শুধুমাত্র কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম, যা গত মাসের থেকে বর্তমানে কেজিতে ৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে টিসিবির তথ্যে বাজারে একমাসের ব্যবধানে মুগডাল, অ্যাংকার ডাল, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনিয়া, রুই মাছ, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, খেজুর ও লবণের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।

ভোগ্যপণ্য নিয়ে কাজ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে দেশে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে যৌক্তিকভাবে যা বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা৷ এখন সব ইস্যুকে সামনে রেখে বাড়তি মুনাফার সুযোগ খোঁজেন তারা। ব্যবসায়ীদের নানান অজুহাত, যার শেষ নেই৷ কারণে-অকারণে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের নাজেহাল করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের এ কারসাজি ঠেকাতে দেশে বেশি কিছু বিদ্যমান আইনও আছে। তবে সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নেই৷ সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে, তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। ”

প্রতি বছরই সংগঠনটি বাজার নিয়ে তাদের গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ বছর এখনও তাদের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। ২০২১ সালের রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে জনাব রহমান বলেন, ‘‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, গত বছরই জীবন-যাত্রার ব্যয় ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ বছরের রিপোর্ট আসলে বর্তমান চিত্রটা বলা যাবে। তবে এবার যে আরও বেড়েছে তাতে তো কোন সন্দেহ নেই। সেই অনুযায়ী, মানুষের আয় বাড়ছে না।”

এদিকে, শুধু খাদ্যপণ্য নয়, বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য্য অন্যান্য পণ্যের দামও। সাবান, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট, নারিকেল তেল, সেভিং ফোম, টালকম পাউডার, রেজারসহ বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়েছে। ব্যয় সামলাতে না পেরে অনেকেই নিত্যব্যবহার্য্য পণ্যের তালিকাও কাটছাঁট করছেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন। এছাড়া আটা-ময়দার দাম বাড়ায় রুটি, কেক, বিস্কুটের মতো বেকারি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আগে চায়ের দোকানে যে রুটি (বনরুটি) ও পিস কেক ৮ টাকা করে বিক্রি হতো, তা এখন ১০ টাকা। আবার ৩০ টাকা দামের ফ্যামেলি রুটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button