গণপরিবহণে যৌন হয়রানির শিকার ৬৩ ভাগেরও বেশি নারী!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঢাকার গণপরিবহণে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন ৬৩ ভাগেরও বেশি নারী। এই যৌন হয়রানির জন্য প্রধানত মধ্যবয়স্ক পুরুষেরা দায়ী বলে এক জরিপে উঠে এসেছে।

আঁচল ফাউন্ডেশনের এই জরিপে মধ্যবয়স্ক পুরুষদের ব্যাপারে যে তথ্য উঠে এসেছে তা কতটুকু যৌক্তিক?

প্রতিষ্ঠানটি মোট ৮০৫ জন ১৩ থেকে ৩৫ বছরের কিশোরী ও তরুণীর মধ্যে জরিপটি করেছে যারা ঢাকায় চলাচলের জন্য বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহণ ব্যবহার করেন৷ তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, কর্মজীবী নারী, গৃহিনী রয়েছেন।

জরিপে ৬৩.৪ ভাগ মেয়ে গণপরিবহনে নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।

আর জরিপে অংশ নেয়া এই নারীদের ৬১.৭ ভাগ যৌন হয়রানির জন্য যে পুরুষদের দায়ী করেছেন তাদের বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছর৷ ৩৬.৩ শাতাংশের বয়স ১৩ থেকে ৩৯ বছর। জরিপে এটা স্পষ্ট যে মধ্যবয়সী পুরুষেরাই প্রধানত গণপরিবহণে যৌন হয়রানির জন্য দায়ী।

এর কারণ জানতে চাইলে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রধান তানসেন রোজ বলেন, এটা নিয়ে তারা আলাদা কোনো গবেষণা বা বিশেষজ্ঞ মতামত নেননি। তবে জরিপে অংশহণকারীরা যে তথ্য দিয়েছেন তার ভিত্তিতে তিনি বলেন-

১.মধ্যবয়সী পুরুষদের সাহস একটু বেশি থাকে।

২. এই বয়সের পুরুষেরা অধিকাংশই বিবাহিত বলে শারীরিক চাহিদা সম্পর্কে তারা বেশি সচেতন থাকে।

৩. নানা তিক্ততা ও সমস্যার কারণে চাহিদা মিটাতে না পারার কারণে বাইরে তার প্রকাশ ঘটে।

৪. তরুণদের চেয়ে এই বয়সের মানুষের লজ্জা কম।

৫. তাদের বয়স বেশি হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সাধারণভাবে মানুষ বিশ্বাস করেনা। এটাও তাদের সুযোগ করে দেয়।

তার কথা, ‘‘এটা জরিপে অংশগ্রণকারীরা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেছেন৷ এর বাইরেও আরো কারণ থাকতে পারে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়রে উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, চার বছর আগে তারাও একটি গবেষণা করেছেন। তখন তারাও একই রকম না হলেও কাছাকাছি রকমের ফলাফল পেয়েছেন। ওই গবেষণায় দেখা গেছে যৌন হয়রানিকারীদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। তার কথা, ‘‘তবে আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপের এজ গ্রুপটি অনেক বড়৷ এর সাথে আমাদের গবেষণা পুরোপুরি মিলানো যাবে না। আর একেকটি গবেষণার পদ্ধতি একেক রকম থাকে।”

তবে দুইটি গবেষণায়ই ৪০ থেকে ৪৫ একটি কমন এজ গ্রুপ পাওয়া যাচ্ছে, যা গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি জানান, ‘‘আমাদের তিন ধরনের পর্যবেক্ষণ ছিলো। নারীরা বলেছেন, গণপরিবহণে নারীদের পর্যাপ্ত আসন থাকে না বলে তারা অনেক সময় বয়স্ক পুরুষের পাশে বসেন। এই সুযোগ তারা নেয়। দ্বিতীয়ত, নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনে অনেক সময় বয়স্ক পুরুষেরা বসেন, এর সুযোগও তারা নেন। তৃতীয়ত, বাসে দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন বয়স্ক পুরুষেরা।”

তার মতে, এই বয়সের পুরুষদের বিয়ে হওয়ার কারণে তাদের যৌন আকাঙ্খা কারুর কারুর বেড়ে যায়। আর তরুণদের চেয়ে তাদের সাহসটাও নানা করণে বেড়ে যায়। এটা সবার ক্ষেত্রে নয়, কারো কারো ক্ষেত্রে হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. হেলাল উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণা নেই। যার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে মধ্যবয়স্ক মানুষ বেশি যৌন হয়রানি করে। তবে সাধারণভাবে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো মধ্যবয়সের পুরুষদের কেউ কেউ একদিকে যৌন অক্ষমতা ও হতাশায় ভোগেন অন্যদিকে যৌন তাগিদ বেড়ে যায়। তারই প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ যৌন হয়রানি করে। অবদমিত সেক্স এটার নেপথ্যে কাজ করে। বাংলাদেশের মত যেসব দেশে সেক্সকে একটি ট্যাবু হিসেবে দেখা হয় সেখানে এই সমস্যা বেশি।”

কেবল যৌন হয়রানি নয়, ধর্ষণের মত অপরাধের ক্ষেত্রেও মধ্যবয়স্করাও জড়িয়ে পড়ছেন বেশি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান।

তার মতে, ৩০ বছরের পরে যখন প্রডাকটিভিটি কমতে থাকে তখন চরিত্রের বিচ্যুতি ঘটতে পারে। অসামাজিক ব্যবহার করতে পারে মানুষ৷ মানসিক চাপ বেড়ে গেলেও এটা হয়, গণপরিবহণে প্রাইভেসি রক্ষা করে যৌন হয়রানি সহজ বলেও মধ্যবয়স্করা হয়তো বেশি জড়িয়ে পড়েন।

গণ পরিবহণে এই যৌন হয়রানির জন্য তরুণ, বাসের স্টাফসহ আরো নানা শ্রেণির লোক জড়িত। আর যৌন হয়রানির সমর্থকও আছে অনেক। এইসব ঘটনায় শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ নারী অভিযোগ করেন।

অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘‘অনেকে এটা স্বাভাবিক বলে মেনে নেন। আবার গণপরিবহণে অভিযোগ করলে উল্টো হয়রানি হতে হয়। তবুও অভিযোগ করতে হবে। তাহলে যৌন হয়রানিকারী ভয় পাবে। আর নারীকে সচেতন হতে হবে। তাদের মধ্যে যৌন নিরাপত্তা বোধ গড়ে তুলতে হবে। তাদের জানতে হবে কোনটা যৌন হয়রানি। যৌন নিপীড়ককে বোঝার মত সচেতন হতে হবে।”

আর ডা. মো. হেলাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ‘‘নারী পুরুষ উভয়কে যৌন শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। এটা হলে নারীও নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। পুরুষও অনেকটাই বিরত থাকবে।”

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button