মুদ্রা ছাপানোর ক্ষমতা হারাতে পারে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক
গাজীপুর কণ্ঠ, আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি রুপি ছাপিয়েছে শ্রীলংকা। ছাপানো এ বিপুল পরিমাণ মুদ্রা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ। একই সময়ে স্থানীয় ব্যাংকগুলোয় তারল্য প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি রুপি। সব মিলিয়ে গত দুই বছরে দেশটিতে মুদ্রার প্রবাহ রীতিমতো মহাপ্লাবনে রূপ নিয়েছে। দেশটিতে গত মাসে শুধু খাদ্য মূল্যস্ফীতিই হয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। চলতি বছরে দেশটির সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৬০ শতাংশে দাঁড়ানোর প্রক্ষেপণ রয়েছে। যদিও তা ১০০ শতাংশ ছাড়ানোর আশঙ্কাও করছেন অনেকে।
মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির ক্রমাগত উল্লম্ফন দেশটির অর্থনীতিকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে। শ্রীলংকাকে সম্ভাবনাময় উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ থেকে দেউলিয়া করে তোলার পেছনে মুদ্রার এ অবাধ প্রবাহ অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, সুদহার কমিয়ে রাখতে গিয়ে অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রবাহ ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলংকা (সিবিএসএল)। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে মুদ্রা ছাপানোর ক্ষমতাই কেড়ে নিতে চাইছেন আইনপ্রণেতারা। দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ২০২৪ সালের মধ্যে মুদ্রা ছাপানো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এতেও আপত্তি তুলে অনেকে বলছেন, তা এখনই বন্ধ করতে না পারলে শ্রীলংকার অর্থনীতির পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অনেকটা একই দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও (আইএমএফ)। মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে শ্রীলংকা সরকারের দৃশ্যমান ও কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছে সংস্থাটি। আইএমএফের প্রতিনিধিরা সম্প্রতি শ্রীলংকা ঘুরে এসে বলেছেন, শ্রীলংকাকে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর ও বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে শ্রীলংকান রুপির বিনিময় হারে। এজন্য ক্রমাগত মুদ্রা ছাপানোর পথ পরিহারের কোনো বিকল্প নেই।
এক্সচেঞ্জ রেটস ইউকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের শুরুতেও শ্রীলংকায় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল প্রায় ১৮১ শ্রীলংকান রুপি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬০ শ্রীলংকান রুপিতে। সে হিসেবে গত দুই বছরে শ্রীলংকান রুপির অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। একই সময়ে মূল্যস্ফীতির হারও ছিল লাগামহীন। দেশটিতে গত মাসে শুধু খাদ্য মূল্যস্ফীতিই হয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। চলতি বছরে দেশটিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৬০ শতাংশ ছাড়ানোর প্রক্ষেপণ রয়েছে। তবে তা ১০০ শতাংশেও দাঁড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন দেশটির নীতিনির্ধারক ও আইনপ্রণেতাদের অনেকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ক্রমাগত মুদ্রা ছাপিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ যে শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছে, সংশ্লিষ্ট সবাই এখন তা বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্যে উঠে এসেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেও স্বীকার করে নিয়েছেন, এ মুহূর্তে আইএমএফের বেইলআউট নিশ্চিত করতে হলে শ্রীলংকান রুপির ক্রমাগত পতন বন্ধ করা ও তা শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বে একটি দল এখন শ্রীলংকার জাতীয় ঋণ পুনর্গঠন কর্মসূচির খসড়া তৈরি করছে। সেখানে দেশটির মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত পরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়েছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা হবে। এজন্য ধীরে ধীরে মুদ্রা ছাপানো বন্ধ করে দেয়া হবে। এ বিষয়ে রনিল বিক্রমাসিংহে সম্প্রতি শ্রীলংকার পার্লামেন্টে বলেছেন, আমরা মুদ্রা ছাপানোর কার্যক্রমকে ভবিষ্যতে সীমিত করে আনতে যাচ্ছি। ২০২৩ সালের মধ্যে আমরা বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সীমিত পরিমাণে মুদ্রা ছাপাব। আমাদের পরিকল্পনা হলো ২০২৪ সাল শেষ হওয়ার আগেই তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া।
রনিল বিক্রমাসিংহের ধীরে ধীরে মুদ্রা ছাপানো বন্ধের পরিকল্পনাটিকে খুব একটা কার্যকর বলে মনে করছেন না দেশটির স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। একই দৃষ্টিভঙ্গি দেশটির অনেক আইনপ্রণেতারও। তাদের ভাষ্যমতে, আইএমএফের শর্ত হলো শ্রীলংকান রুপির অবমূল্যায়ন ঠেকিয়ে এটিকে শক্তিশালী করতে হবে। আগস্টে সংস্থাটির সঙ্গে শ্রীলংকার বেইলআউট প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা শুরুর আগেই বিষয়টি নিয়ে দৃশ্যমান ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এজন্য এ মুহূর্তে শ্রীলংকায় মুদ্রা ছাপানো বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টে এখন জোর বিতর্ক চলছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা চালানো সহজ হবে না বলে স্বীকার করে নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তার ভাষ্যমতে এতদিন শ্রীলংকা সংস্থাটির সঙ্গে আলোচনা বা দরকষাকষি চালিয়েছে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে। কিন্তু এবার এ আলোচনায় বসতে হচ্ছে দেউলিয়া হয়ে পড়া একটি দেশের প্রতিনিধি হিসেবে। সে হিসেবে শ্রীলংকার জন্য এবারের আলোচনা অনেক জটিল ও কঠিন হতে যাচ্ছে।
শ্রীলংকার অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনই মুদ্রা ছাপানো বন্ধের ঘোষণা দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শ্রীলংকার এখন আইএমএফ ছাড়া আর কোনো গতি নেই। আইএমএফের শর্ত মানার পাশাপাশি দেশটিকে এখন মুদ্রানীতিতে সংশোধন আনতে হবে। এজন্য দেশটির প্রয়োজন এখন মুদ্রা ছাপানো বন্ধ করে রাজস্ব বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া। শ্রীলংকার অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও কিছু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ঋণ ও আমানতের সুদহার বা মুদ্রার বিনিময় হার চাপিয়ে দেয়ার মতো বিষয়গুলো একপর্যায়ে আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংক ও মুদ্রা ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে এ ধরনের চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে হবে।
শ্রীলংকার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দেশটির রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও দায়ী করছেন অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা। লংকান ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে, যখনই অভ্যন্তরীণ বাজারে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে, তখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের বদলে নতুন করে মুদ্রা ছাপানোর পথে হেঁটেছে। এক্ষেত্রে সরকারি ঋণ বাড়ছে না বেসরকারি ঋণ বাড়ছে—তা কখনোই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সাধারণ লংকান নাগরিকদের এখন এরই বিপর্যয়কর ফলাফল বহন করতে হচ্ছে। সুদহার কমিয়ে রাখতে গিয়ে মুদ্রাবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়িয়েছে সিবিএসএল। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোও শ্রীলংকান রুপির বিনিময় হার একেবারে ধসে পড়ার আগ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা এতদিন মুদ্রাবাজার পরিচালনায় সর্বময় ক্ষমতা উপভোগ করে এসেছেন। ২০২০ সালে শ্রীলংকায় অর্থনৈতিক সংকট শুরুর কালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ডব্লিউ ডি লাক্সমান। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে নিয়োজিত এ অর্থনীতিবিদ সিবিএসএলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে ডব্লিউডি লাক্সমান শ্রীলংকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত ব্যক্তিদের একজন। ক্রমাগত মুদ্রা ছাপিয়ে অর্থনীতিকে ভারগ্রস্ত করে তোলার জন্য তাকে অনেকাংশেই দায়ী করা হয়।
ডব্লিউডি লাক্সমানের পথে হেঁটেছিলেন অজিত নিভারদ কাবরালও। এর আগে মাহিন্দা রাজাপাকসের অধীনে ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সিবিএসএলের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন রাজাপাকসেদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অজিত নিভারদ কাবরাল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ডব্লিউ ডি লাক্সমান দায়িত্ব ছাড়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো সিবিএসএলের গভর্নর হন তিনি। শ্রীলংকার অর্থনীতিতে বিপর্যয় স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরেও মুদ্রা ছাপানোর পথ পরিহার করেননি তিনি।
শ্রীলংকা নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার পর চলতি বছরের এপ্রিলে তিনি গভর্নরের পদ ছেড়ে দেন। ওই মাসেই তার বিরুদ্ধে শ্রীলংকা ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদেশ জারি করে কলম্বোর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। সে সময় রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপব্যবহারের মাধ্যমে শ্রীলংকাকে ইতিহাসের ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকটে ঠেলে দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল।