তমলুক বন্দরের বাণিজ্যপণ্য

অথ কস্মিংশ্চি [ত্ স]ময়ে বাণিজো ভ্রাতরস্ত্রয়ঃ।

তাম্রলিপ্তি [ম] যোধ্যায়া যযুঃ পূর্বম্বণিজয়া।।

ভূয়ঃ প্রতিনিবৃত্তান্তে সমাবাসং বিয়াসবঃ।

প্রয়োজনেন কেনাপি চিরঞ্চক্কুরিহ স্থিতিং।।

সুবর্ণ মণি মাণিক্য মুক্তা প্রভৃতি যৈর্ধানং।

বিত্তপষ্পর্ধয়েবা সোদপর্যন্তমুপাজিতং।।

ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের হাজারিবাগ জেলার দুধপানি পাহাড়ে উত্কীর্ণ উপর্যুক্ত শ্লোকগুলোর কাল নির্ণয় কিছুটা অনুমাননির্ভর। সংস্কৃত ভাষার লেখটিতে বলা হয়েছে যে কোনো একসময়ে ব্যবসা করার জন্য তিন ভাই অযোধ্যা থেকে তাম্রলিপ্তিতে এসেছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা প্রচুর ধনসম্পদ (সুবর্ণ মণি মাণিক্য মুক্তা) আয় করে নিজেদের দেশে ফেরত গিয়েছিলেন। পুরালেখবিদ্যার মানদণ্ডে লেখটি আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীর। প্রথম লাইনের বক্তব্য ইঙ্গিত করে যে বণিক ভ্রাতাত্রয়ের ‘তাম্রলিপ্তি’তে এসে অর্থ উপার্জনের ঘটনাটি একটি অতীতকালের স্মৃতি। লেখটির ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তেমন নেই। কেননা আদি পর্বের বাংলায় সমুদ্রবন্দরগুলোর মধ্যে তাম্রলিপ্তির জীবন্ত উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় দেশজ ও বিদেশী সূত্রগুলোতে। তাম্রলিপ্তি ছাড়াও আসমুদ্রহিমাচল খ্যাত ‘বাংলা’ অঞ্চলের প্রাচীন সমুদ্রবন্দর ছিল—গাঙ্গে (চন্দ্রকেতুগড়) এবং সমন্দর (চট্টগ্রাম)। অযোধ্যা থেকে আসা তিন ভাইয়ের স্বর্ণ-মুক্তা-মাণিক্য অর্জনের গোপন রহস্য ছিল তাম্রলিপ্ত বন্দরের পণ্য আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে অংশগ্রহণ। কিন্তু কোন কোন পণ্য ছিল জনপ্রিয় বা আজকের ভাষায় ‘চালু আইটেম’ সে বিষয়ে লেখাটি নিশ্চুপ।

‘তাম্রলিপ্ত’ বন্দরটি গ্রিক-ল্যাটিন বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিল ভূগোলবিদ টলেমির লেখার মাধ্যমে। টলেমির ‘ত্যামালিটেস’ বা প্লিনির ‘তালুকেট’র বর্তমান অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরে। প্রাচীন সূত্র অনুযায়ী তাম্রলিপ্তি বন্দরটির অবস্থান ছিল গঙ্গা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থলে। কিন্তু বর্তমানে গঙ্গার গতিপথের পরিবর্তন প্রক্রিয়ার ফলে স্থানটি নদী থেকে প্রায় ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত। এমনকি হুগলি নদীর হলদিয়া বন্দরটিও প্রায় ২০ মাইল পূর্বদিকে থাকা একমাত্র নিকটবর্তী নদীবন্দর। সমুদ্রবন্দর মানেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য; বাণিজ্যের সূত্র ধরে ধর্ম-সংস্কৃতির আদান-প্রদান। অর্থনৈতিক ইতিহাস, হালফিলের সমুদ্রবলয় ও মহাদেশীয় যোগাযোগসূত্রের আলাপ কিংবা তত্ত্ব কাঠামোর অলিগলি এড়িয়ে তাম্রলিপ্তি বন্দরের বাণিজ্যদ্রব্যের পরিচয় তুলে ধরাই আমার আজকের প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। নতুন প্রস্তাব নয়, বরং প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণায় পাওয়া তথ্য সাধারণ পাঠক সমীপে উপস্থাপনই এই লেখার প্রাণ।

প্রবাদপ্রতিম ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব গ্রন্থটির চতুর্থ অধ্যায় ‘ধন-সম্বল’-এ বাংলার মানুষের ধনোত্পাদনের তিনটি উপায়—কৃষি, শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন। ‘ব্যবসা বাণিজ্য’ উপশিরোনামে তিনি গ্রামীণ হাট থেকে আন্তর্জাতিক বন্দরের বাণিজ্য পণ্য, আমদানি-রফতানি ও এর পদ্ধতিগত নানা দিক আলোচনা করেন। রায়ের মতে, বাংলার বাণিজ্যপণ্যের মধ্যে ছিল পান, গুবাক, নারিকেল, পিপলি, লবণ, রেশম, কার্পাস, বস্ত্র, চাল ইত্যাদি। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পণ্য হিসেবে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা ছিল। এই তালিকায় থাকা বস্ত্র ও চালের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারেও ছিল। বাংলার বন্দরগুলোর মাধ্যমে আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো। উল্লেখ্য, এ ধরনের অনুমানের সমর্থন পাওয়া যায় তাম্রলিপ্তি ও চন্দ্রকেতুগড়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শনাদি এবং গ্রিক-রোমান বর্ণনায়। তাম্রলিপি এবং চন্দ্রকেতুগড়ের বহু পোড়ামাটির শিল্পবস্তুতে ধান এবং সশীষ ধান দৃশ্যায়িত হয়েছে। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘ধানের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও সমুদ্র বাণিজ্যের পণ্য…তা মেনে নিতে অসুবিধা নেই।’

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে অজানা নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস মারিস এরিথ্রাই’ (পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি) গ্রন্থে গঙ্গা দেশের অতি মসৃণ সুতিবস্ত্রের উল্লেখ আছে। একাধিক গ্রিক-ল্যাটিন লেখকের রচনায় বাংলার কাপড়ের প্রশংসা পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের বাণিজ্য জগতে বাংলার কাপড়ের সুখ্যাতির গল্প শুনিয়েছেন মহামান্য চাণক্য (চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য)। অর্থশাস্ত্রে বাংলার তিনটি অঞ্চলের কাপড়ের গুণাগুণ সম্পর্কে বলা হয়—(ক) বঙ্গের সুতীবস্ত্র (দুকূলম) শুভ্র ও মোলায়েম (শ্বেতস্নিগ্ধম); (খ) পুণ্ড্রের সূতিবস্ত্র শ্যামবর্ণ ও মণির ন্যায় পেলব (শ্যামম্ মণিস্নিগ্ধম); এবং (গ) সুবর্ণকুড়্য (পশ্চিম বাংলা)-এর বস্ত্রের রং সূর্যের মতো। এছাড়া এটি জলের মতো মসৃণ বুননের; কখনো একই রকম আবার কখনো মিশ্র বুননের (সূর্য্যবর্ণ মনিস্নিগ্ধো দক্বনম্ চতুরশ্রবানম ব্যামিশ্রবানমচ্)। এই ভাবনা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে এ ধরনের ‘মানসম্পন্ন’ কাপড় বাংলার সমুদ্রবন্দরগুলোতে বিশেষত তাম্রলিপ্তিতেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় বাণিজ্যপণ্য হিসেবে গণ্য হতো।

বাংলার উপকূলীয় এলাকার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বন্দরগুলোর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সম্প্রতি গ্রিক ভাষায় প্যাপিরাসের ওপর লিখিত একটি দলিলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সমুদ্রবাণিজ্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো দলিলটি বর্তমানে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার একটি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত। সমুদ্রবাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই ঋণচুক্তিটিতে মালাবারের মুজিরিস বন্দরে হার্মোপোলেন নামে অপেক্ষমাণ জাহাজের উল্লেখ রয়েছে। সম্ভবত জাহাজটির গন্তব্য ছিল বেরেনিক অথবা মিওস হরমোস বন্দর। জাহাজে থাকা পণ্য মিসরীয় উপকূলের এই দুই বন্দরে মালপত্র খালাস করে তা প্রথমে উটের পিঠে এবং পরে নীলনদের নৌকার মাধ্যমে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে পাঠানো হবে। মুজিরিস বন্দর থেকে ছয় ধরনের ভারতীয় পণ্য জাহাজে তোলা হবে। এদের মধ্যে রয়েছে ‘গ্যাঞ্জেটিক নার্ড’। যে পাত্রগুলোতে গ্যাঞ্জেটিক নার্ড মজুদকৃত ছিল সেগুলোর প্রত্যেকটির মূল্য ছিল ৪ হাজার ৫০০ দ্রাখ্মা। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট হবে অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর নিম্নোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে:

নার্ড…আসলে এক দুষ্প্রাপ্য সুগন্ধি তেল। সংস্কৃততে যাকে নালদ বলা হয়েছে, গ্রিক নার্ড তার সমার্থক। এটি একটি বনজ সম্পদ, গাছ থেকে এই সুগন্ধি তেল নিষ্কাশন করা হয়। নার্ডকে যদিও ঋণচুক্তির দলিলে গ্যাঞ্জেটিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, গাঙ্গেয় বদ্বীপে এই বৃক্ষ জন্মায় না। তার উত্পত্তি স্থান হিমালয়ের পার্বত্য এলাকায়। সুতরাং এই বৃক্ষজাত সুগন্ধি তেল প্রথমে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে স্থলপথে বা পানিপথে (বা উভয়ই) গাঙ্গেয় বদ্বীপে আনা হতো। সেখান থেকে সম্ভবত তাম্রলিপ্ত বা চন্দ্রকেতুগড় বন্দরের মাধ্যমে, সমুদ্রবাণিজ্যের সুবাদে তা পৌঁছাত কোরমণ্ডল বা মালাবার উপকূলে।

ভিয়েনায় থাকা গ্রিক ভাষার ঋণ চুক্তিটির বক্তব্য বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট যে বস্ত্র ও চালের পাশাপাশি তাম্রলিপ্তি বন্দরের অন্যতম বাণিজ্যপণ্য ছিল গ্যাঞ্জেটিক নার্ড।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি মান্যবর কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলা এবং পশ্চিম বাংলার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের আদি ঐতিহাসিক পর্বের প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ গবেষণায় তমলুক ও পার্শ্ববর্তী প্রত্নস্থানগুলোতে প্রাপ্ত নিদর্শনাদির নথিভুক্তি ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, এ এলাকায় প্রচুর পুঁতি পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুঁতি এবং কাচের পুঁতি। স্বল্পমূল্যবান পুঁতি তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে আকিক, জ্যাসপার, কার্নেলিয়ান। কাচের পুঁতিগুলো অধিকাংশই অস্বচ্ছ—লাল, নীল, কালো ও হলুদ বর্ণের। প্রত্নতত্ত্ববিদ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘সম্ভবত কাচের পুঁতি তমলুকের নিজস্ব চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো এবং এখান থেকে পুঁতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রফতানিও করা হতো।’

সমকালীন সূত্রগুলোতে সপ্তম শতাব্দীর পর থেকে আর তাম্রলিপ্তি বন্দরের উল্লেখ মেলে না। অষ্টম শতাব্দী থেকে আরবীয় সূত্রগুলোতে বাংলার উপকূলীয় বন্দর ‘সমন্দর’ থেকে ‘আবলুস কাঠ’ আর ‘চাল’ রফতানির সংবাদ পাওয়া যায়। সম্ভবত তাম্রলিপ্তি বন্দর সমুদ্রগামী বাণিজ্য তরী ভেড়ানোর উপযুক্ততা হারিয়ে ফেলে। নাব্যতা সংকট কিংবা নদীর গতিপরিবর্তন যার পটভূমিতে ত্রীড়নক ছিল। বাংলার সুতি বস্ত্রের সুখ্যাতিও ছিল প্রবহমান। অযোধ্যার তিন ভাইয়ের মতো আরো অসংখ্য মুসাফিরের নতুন গন্তব্য হয়ে ওঠে ‘বাহর-উল-হরকন্দ’-এর উপকূলীয় বণিজ্য কেন্দ্র ‘সমন্দর’।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব, কলকাতা; দে’জ প্রকাশনী,

২. আবদুল মমিন চৌধুরী (সম্পা.), বাংলাদেশের ইতিহাস আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে আদি বাংলা (আনু. ১২০০ সা অব্দ পর্যন্ত), প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০১৯।

৩. কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, ‘তমলুক’, আবদুল মমিন চৌধুরী (সম্পা.), বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ২০১৯, পৃ. ২৪৯-৬২।

৪. রণবীর চক্রবর্তী, ‘অর্থনৈতিক জীবন: কৃষিকর্ম এবং কৃষিবহির্ভূত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ’, আবদুল মমিন চৌধুরী (সম্পা.), বাংলাদেশের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, ২০১৯, পৃ. ৯৩-১৭৮।

৫. কল্যাণ রুদ্র, বাংলার নদীকথা, কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ২০১০।

৬. Shahnaj Husne Jahan, Maritime Ports in Bengal, Dhaka: Centre for Heritage Studies, 2021.

লেখক : শহিদুল হাসান, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button