রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানি কতটা সম্ভব?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : রাশিয়া থেকে কম দামে জ্বালানি তেল আমদানির সাম্ভাব্যতা যাচাই করছে বাংলাদেশ। জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটির বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি কীভাবে করা যায় তার উপায় খুঁজে দেখতে বলেছেন।
গত মে মাসে প্রথম রাশিয়া বাংলাদেশে জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রস্তাব দেয়। তবে দুই সপ্তাহ আগে ফের প্রস্তাব দিলে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে। এরই মধ্যে তাদের প্রস্তাব খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটিও গঠন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন(বিপিসি)। প্রথমবার মে মাসে প্রস্তাবের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘‘রাশিয়ার তেল শোধনের উপযোগী রিফাইনারি বাংলাদেশে নাই। আর এ ধরনের প্ল্যান্ট করতে কমপক্ষে পাঁচ বছর লেগে যাবে।” কিন্তু রাশিয়া এখন পরিশোধিত তেল রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে এবং তা অনেক কম দামে।
বিপিসির হিসাবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্তবাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। এ সময় অপরিশোধিত তেল এসেছে আট লাখ ৭০ হাজার টন। বাংলাদেশ মূলত অপরিশোধিত তেল কেনে সৌদি আরবের সৌদি আরামকো এবং আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি থেকে। আর পরিশোধিত তেল সরবরাহ করে কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের আটটি কোম্পানি থেকে৷ এর মধ্যে চীনের কোম্পানি দুটি।
ইস্টার্ন রিফাইনারির এরকজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের শোধনাগারে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করা সম্ভব নয়। কারণ এর ঘনত্ব মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেলের তুলনায় বেশি।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সংবাদমাধ্যমেকে বলেছেন, ‘‘শোধনের বিষয়টি দেখতে রুশ বিশেষজ্ঞরা শিগগিরই বাংলাদেশে আসছেন। তারা স্থানীয় শোধনাগারগুলি পরিদর্শন করে এখানে রাশিয়ান তেল পরিশোধনের উপায় বের করবেন। এরপর আমরা সেগুলি সংস্কারের উদ্যোগ নেব। তবে এটাকে প্রধান বাধা মনে করা হচ্ছেনা। কারণ বিকল্প ব্যবস্থা আছে। রিফাইন করা জ্বালানি তেল আনা যায়। আবার তৃতীয় কোনো দেশেও রিফাইন করা যায়। কিন্তু বড় বাধা হলো ইউক্রেন আক্রমণের কারণে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা। আর বাংলাদেশ কীভাবে তেলের অর্থ পরিশোধ করবে তার উপায় বের করা।”
রাশিয়ার প্রস্তাব:
‘হিউজটন’ নামে একটি কোম্পানি রাশিয়ার পরিশোধিত ডিজেল বিক্রির প্রস্তাব জমা দিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। তারা প্রতি ব্যারেল ৫৭ টাকা দর দিয়েছে। প্রতি লিটারের দাম পড়বে ৪০ টাকার কম। তেল জাহাজে পাঠানো হবে দুবাই থেকে। এছাড়া প্রতি টন রাশিয়ান ডিজেল ৪২৫ ইউএস ডলারে দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। তাতে প্রতি ব্যারেলের (১৫৯ লিটার) দাম পড়ে ৫৭ দশমিক ৪৩ ডলার। ডলার ১১০ টাকা হিসেবে ধরলে প্রতি লিটারের আমদানি খরচ পড়বে ৪০ টাকার কম।
অন্যদিকে বাংলাদেশের কাছে প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত ডিজেল ৫৯ ডলারে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়ার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রসনেফট অয়েল। প্রতিষ্ঠানটি এই দরে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের সংকট চলছে। বিশ্ব বাজারে এর দাম কমলেও বাংলাদেশে এখনো উচ্চমূল্যেই বিক্রি হচ্ছে। চলতি মাসেই নজিরবিহীনভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা করা হয়েছে। পেট্রোলের দাম ৫১.৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা লিটার। অকটেনের দাম ৫১.৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা লিটার।
রাশিয়া থেতে তেল আমদানি করতে পারলে বাংলাদেশ এই জটিল পরিস্থিতি ধেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমাদনি করলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের(ইইউ) প্রতিক্রিয়া কী হবে। কারণ ওই সব দেশে বাংলাদেশ ৩৫-৪০ বিলিয়নের পণ্য রপ্তানি করে৷ যার মধ্যে তৈরি পোশাকই প্রধান।
বাংলা কি পারবে রাশিয়ার তেল আনতে?
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম. তামিম মনে করেন রাশিয়ার তেল আমদানিতে কতগুলো ইস্যু আছে।
সেগুলি হলো,
১.পেমেন্ট কীভাবে করা হবে। ডলার নিয়ে সমস্যা আছে। ২. রাশিয়া কতখানি ছাড় বা ডিসকাউন্ট দেবে। ৩. প্রোডাক্ট না ক্রুড অয়েল আনা হবে। ৪. ক্রুড আনলে সেটা প্রসেস করতে রিফাইনারির অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। তাতে কত দিন সময় লাগবে। খরচ কত পড়বে। ৫. ক্রুড থেকে কতখানি সেভিংস হবে- এরকম আরো অনেক বিষয় আছে। এখন কমিটি সেগুলো দেখছে। কমিটি প্রতিবেদন দিলে বোঝা যাবে।
তিনি বলেন, ‘‘ক্রুডের ব্যাপারে আমি বেশি একটা আশাবাদী নয়। তবে যদি রিফাইন জ্বালানি আনা যায় তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে। যদি ফিনিশড ডিজেল আনতে পারি, সেটা যদি ডিসকাউন্টে দেয় ট্রান্সপোর্ট কস্টসহ তাহলে সেটা আমাদের জন্য লাভজনক হবে।”
নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে আমাদের কূটনৈতিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চাপে আছে। ভারতকে তো রেহাই দেয়া হয়েছে। সেটা যদি আমিরা বুঝাতে পারি তাহলে হবে। এটা অসম্ভব কিছু নয়।”
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘আমাদের আনতে হবে রিফাইনড অয়েল। ক্রুড এনে আমাদের লাভ নেই। কারণ ক্রুড প্রসেস করা মত আমাদের সক্ষমতা নাই। রাশিয়া সর্বশেষ প্রস্তাবে রিফাইনড অয়েল রপ্তানির কথা বলেছে। সেটা আমাদের জন্য সুযোগ।”
তবে এখানে আরো কয়েকটি বিষয় আছে সেগুলো কীভাবে সেটেলড করা হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রাশিয়ার সঙ্গে একটা বিনিময় চুক্তি করতে হবে। ,পেমেন্টটা আমরা কীভাবে দেব সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ডলারে সুইফট সিস্টেমে দিতে পারবনা। সেক্ষেত্রে চীনা মুদ্রা একটি বিকল্প হতে পারে। আর চাইলেও রুবলেদেয়া যাবেনা। কারণ রুবল পাওয়া যাবেনা। আরেকভাবে হতে পারে। আমরা যে এক্সপোর্ট করি তার মাধ্যমেও সরাসরি দিতে পারি।”
তার মতে, ‘‘আমরা তো আর ভারতের মতো পারবনা। ভারতের শক্তি আছে তাই সে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল আনছে। আর শেষ পর্যন্ত তাকে আইন পরিবর্তন করে রেহাই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের কূটনৈতিক পর্যায়ে বুঝাতে হবে যে আমরা ক্রাইসিস-এ আছি। সেটা বোঝানো গেলে তারা ওভারলুক করতে পারে।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে