প্লট-ফ্ল্যাট প্রতারণা: ২৫ হাজার গ্রাহকের পাওনা ৩২ হাজার কোটি টাকা, নিঃস্ব অনেকে

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : অনলাইনে লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে কোটি টাকা দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট কিনে রাজধানীতে প্রতারণার শিকার হয়েছেন অন্তত ২৫ হাজার গ্রাহক। এ নিয়ে মামলা করেও টাকা আদায় করতে পারছেন না তারা। এ রকম কয়েক হাজার মামলায় এসব গ্রাহকের প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা কিছু নামসর্বস্ব রিয়েল এস্টেট ও হাউজিং কোম্পানির কাছে আটকে আছে। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অনেকে।

জানা গেছে, আধুনিক রাজধানী পূর্বাচল প্রকল্পের কাছাকাছি কয়েক ডজন হাউজিং কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে অনেকেরই অনুমোদন নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। এরমধ্যে রয়েছে-নর্থ সাউথ সিটি, ইউরো স্টার সিটি, বন্ধন সিটি, ওয়েলকেয়ার সিটি, পূর্বাচল সিটি, সিটি ক্লাউড, কানাডা সিটি, জমিদার সিটি, হোমল্যান্ড পূর্বাচল সিটি, হোমটাউন পূর্বাচল সিটি, প্রিটি রিয়েল এস্টেট, মাসকট গ্রীন সিটি, পুষ্পিতা এম্পায়ার হাউজিং, নন্দন সিটি, বেস্টওয়ে সিটি, মালুম সিটি, মেরিন সিটি, সোপান সিটি, ইউনাইটেড পূর্বাচল ল্যান্ডস লিমিটেড, এজি প্রপার্টিজ লিমিটেড, নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, বিশ্বাস বিল্ডার্স লিমিটেড, নীলাচল হাউজিং লিমিটেড, বাগান বিলাস, রূপায়ণ ল্যান্ডস লিমিটেড, আদর্শ আইডিয়াল লিমিটেড, তেপান্তর হাউজিং, মেট্রোপলিটন ক্রিশ্চিয়ান কো-অপারেটিভ হাউজিং, মঞ্জিল হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, শিকদার রয়েল সিটি, কপোতাক্ষ গ্রীন সিটি, ডিভাইন হোল্ডিং লিমিটেড, শতাব্দী হাউজিং, স্বর্ণ ছায়া রিয়েল এস্টেট, ভিশন ২১ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, ওশান হ্যাভেন লিমিটেড ও এসএফএল চন্দ্রিমা লিমিটেড। এর আগে পূর্বাচলের পাশে গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের খাল-বিল, নদী-পুকুর ও জলাশয় ভরাট ও অবৈধ দখলের অভিযোগে তাদের কার্যক্রমের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু এসব কোম্পানির মালিকদের ক্ষমতার কাছে পরাজিত আইনের শাসন।

সংবিধানের ১৮ ক অনুচ্ছেদ, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর বিধান অনুযায়ী খাল-বিল, নদী-পুকুর ও জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ। অথচ এসব ভুঁইফোঁড় হাউজিং কোম্পানি দেদার নদী-পুকুর ভরাট করে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। চূড়ান্ত অনুমোদন ছাড়াই নর্থ সাউথ সিটি ও ইউরো স্টার সিটি বিভিন্ন জলাশয় ভরাট করে সাইনবোর্ড-বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে। ওয়েলকেয়ার সিটি আবাসন প্রকল্পে দুই হাজার ক্রেতা প্লট কিনলেও সেগুলো হস্তান্তর করা হয়নি। এর কারণ রাজউক এবং অন্যান্য দপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই জলাশয়, আবাদি জমি দখল করে গড়ে উঠা প্রকল্পটি ২০১৯ সালের এপ্রিলে রাজউক বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে বিপাকে পড়েন ২ হাজার ক্রেতা। পরে তারা ঢাকার আদালতে মামলা করেন।

কয়েকজন প্রতারিত গ্রাহক যুগান্তরকে বলেন, আমরা (২ হাজার প্লটের ক্রেতা) পৃথকভাবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে ৪০টি মামলা করেছি। যদিও এসব মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন ওয়েলকেয়ার সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ও ২৮টি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্লট-সংক্রান্ত প্রতারণার অভিযোগে করা কয়েক হাজার মামলা বিচারাধীন। এসব মামলায় গ্রাহকদের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এছাড়া ঢাকা জেলা আদালত ও আটটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরও কয়েক হাজার মামলা চলছে। এসব মামলার বিপরীতে গ্রাহক পাওনা প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা, বাড্ডা, মেরুল, আফতাবনগর, বনশ্রী, খিলগাঁও, রামপুরাসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকায় অভিনব পন্থায় জমির শেয়ারের প্রলোভন দেখিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রির চমকপ্রদ অনলাইন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিুবিত্ত এবং প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। রিমি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং, লাবিবা বিল্ডার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্ট, ক্রিস্টাল বিল্ডার্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন, উদয় বিল্ডার্স, ডেনিবার বিল্ডার্স, আরকাম বিল্ডার্স, এনজি বিল্ডার্স অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

ভুক্তভোগী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামাল শেখ বলেন, ‘ক্রিস্টাল বিল্ডার্সে জমির শেয়ারে অর্ধেক খরচে ফ্ল্যাট’ অনলাইনে এই শিরোনামে বিজ্ঞাপন দেখে তাদের অফিসে যাই। তাদের মন ভোলানো কথায় কাবু হয়ে যাই। একটি ইনস্টলমেন্ট দিয়ে বায়নাপত্রও করি। কিন্তু দ্বিতীয় ইনস্টলমেন্ট দেওয়ার সময় দেখি তাদের নানা ধরনের বাহানা-ফ্ল্যাট সাইজ কম-বেশি হবে, লটারির মাধ্যমে ফ্লোর নির্ধারণ করা হবে। অথচ শুরুতে বলেছিল, ‘আপনি যে ফ্লোর ইচ্ছা সেই ফ্লোরই নিতে পারবেন। আসলে তারা এক ফ্ল্যাট ৫ জনের কাছে বিক্রি করে এবং প্রতারণাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।

রামপুরার দক্ষিণ বনশ্রীতে ২০২০ সালে এনজি বিল্ডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির মাধ্যমে বাড়ি করার জন্য জমি হস্তান্তর করেন এর মালিক আসিফ সৌরভ। ওই বাড়িটিতে ১৮টি ফ্ল্যাট করার কথা ছিল। প্রথম ফ্লোর নির্মাণ করার পরই সব ফ্ল্যাট অগ্রিম বিক্রি করে দেন এনজি বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান হায়দার আজম। এরপর হঠাৎ ২০২১ সালের মার্চে বাড়িটির কাজ বন্ধ করে কোম্পানি লাপাত্তা হয়ে যায়। জমির মালিক আসিফ সৌরভ বলেন, আমার সম্পদ বলতে এই ৩ কাঠা জায়গা ছিল। জানি না আমার ভাগ্যে কি আছে।

ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালত ও ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সূত্রে জানা যায়, ফ্ল্যাট কিনে প্রতারণার অভিযোগে হাজারের বেশি মামলা রয়েছে। যার বিপরীতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা আটকা রয়েছে ফ্ল্যাট ক্রেতাদের। সুপ্রিমকোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকের মামলা রয়েছে। কোম্পানিগুলোর কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ বলেন, অনেক হাউজিং কোম্পানির বিরুদ্ধেই অভিযোগ রয়েছে। সেগুলোর তদন্তও হচ্ছে। সেভাবেই আমরা ব্যবস্থা নেব। পূর্বাচলের কিছু ভুঁইফোঁড় হাউজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। বাকিগুলোর বিরুদ্ধেও নেওয়া হবে। তিনি যাচাই-বাছাই করে প্লট-ফ্ল্যাট ক্রয়ের পরামর্শ দিয়েছেন।

 

সূত্র: যুগান্তর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button