ড্রেজিং সক্ষমতার অভাবে মোংলা বন্দর বালি ফেলবে ফসলি জমিতে, আন্দোলনে কৃষকরা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশের অন্যতম সমুদ্রবন্দর মোংলার পশুর চ্যানেল খননের কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের মার্চে। প্রায় দুই বছর পেরোলেও খননকাজ খুব একটা এগোতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর কারণ হিসেবে উঠে এসেছে স্থানীয়দের তিন ফসলি জমিতে বন্দর কর্তৃপক্ষের বালি ফেলার সিদ্ধান্তের কথা। অর্থাৎ মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ চায়, নদী খনন শেষে পাওয়া বালি স্থানীয়দের জমিতে ফেলতে। ফসলি জমিতে বালি ফেলা হলে তার উর্বরতা নষ্ট হয়, ফসল জন্মানোর ক্ষমতা কমে যায়। তাই এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন কৃষকরা। এ আন্দোলন ও বিরোধিতার কারণেই মূলত খননকাজে কোনো অগ্রগতি নেই।
জানা গিয়েছে, নদী খননের মাটিকে পলি মাটি আখ্যা দিয়ে দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ৩০০ একর জমিতে বালি ফেলতে চাইছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এভাবে কৃষিজমিতে নদীর তলদেশের মাটি ফেলার কারণে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। বাগেরহাটের মোংলার চিলা এলাকার প্রায় ৭০০ একর কৃষিজমিতে পশুর চ্যানেলের প্রথম পর্যায়ের ড্রেজিংয়ের বালি ফেলার কারণে সেখানে এখন আর কোনো ফসলই ফলছে না।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ড্রেজিংয়ের নামে তিন ফসলি জমিতে মাটি ভরাট করতে জমি হুকুম দখলে নেয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ফসলি জমি পতিত হওয়ার পাশাপাশি কৃষিনির্ভরশীল অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য প্রায় দেড় বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান আসেনি।
নাব্যতা সংকট কাটাতে বন্দরের জেটিতে স্বাভাবিক জোয়ারে ৯ দশমিক ৫০ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশের সুবিধার্থে জয়মনির ঘোল থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার ইনারবারে ২১৬ দশমিক ৯ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। বন্দর সূত্র জানিয়েছে, ড্রেজিং প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯৩ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। চলতি বছরের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মহামারীর কারণে তা হয়নি। চলতি আগস্টে ড্রেজিং শুরু করতে গেলে স্থানীয় কৃষকরা বাধা দেন। এতে কাজ আবার বন্ধ হয়ে যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, বানিশান্তার কৃষিজমিতে ধান ফলেছে। মাসখানেক পর ধান কাটার উপযুক্ত হবে উল্লেখ করে স্থানীয় কৃষক জয় মণ্ডল বলেন, আমার ১২ বিঘা জমি রয়েছে এখানে। বছরে তিনবার ফসল ফলাই এখানে। কিছুদিন আগে তরমুজ ও রবিশস্য করেছি। সরকার যদি আমাদের কৃষিজমি নষ্ট করে, তাহলে আমাদের যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা থাকবে না।
আরেক কৃষক ননী মণ্ডল বলেন, আমাদের বলা হচ্ছে বালি ফেললেও এখানে ফসল ফলবে। এটা মিথ্যা কথা। এর আগে চিলা এলাকায় বালি ফেলা হয়েছে, সেখানে কোনো ফসলই ফলছে না। এখানে বালি ফেলা মানে আমাদের সর্বনাশ করা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সংশ্লিষ্ট জমিটি উর্বর কৃষিজমি এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা বালি ফেলার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিকল্প চারটি জায়গা দেখিয়েছি। এর মধ্যে একটি জায়গা তিন কিলোমিটারের ভেতর, তারা চাইলে সেখানে বালি ফেলতে পারে। সেটি না করে কেন তাদের কৃষিজমি বেছে নিতে হলো? তাছাড়া প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের ওখানে বালি লাগবে, ছয় লেনের রাস্তা হচ্ছে সেখানেও বালি লাগবে, বন্দর কর্তৃপক্ষ সেখানে বালি ফেলুক।
বিকল্প জায়গা থাকা সত্ত্বেও কৃষিজমিতে নদী খননের বালি ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে মোংলা বন্দরের বোর্ড ও জনসংযোগ বিভাগের সচিব কালাচাঁদ সিংহ বলেন, কৃষকদের বক্তব্য অযৌক্তিক। জমিটি তিন ফসলি নয়, দুই ফসলি। বিকল্প জায়গাগুলোর দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমরা বানিশান্তায় মাটি ফেলব। আমাদের ড্রেজিংয়ের ধারণ ক্ষমতা নেই। যারা কৃষকদের সঙ্গে আন্দোলন করছে তারা আমাদের শক্তিশালী ড্রেজিং মেশিন সম্পর্কে তথ্য দিলে বিকল্প স্থানগুলোর কথা আমরা ভেবে দেখব।
আন্দোলনকারী স্থানীয় কৃষক নেতাদের অভিযোগ, চট্টগ্রামে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ড্রেজিং মেশিন থাকলেও মোংলা বন্দর তা ব্যবহার করতে চাইছে না। যদি সক্ষমতা না থাকে তাহলে বন্দর কর্তৃপক্ষের উচিত তা বাড়ানো। সামনে যখন আবার খননকাজের প্রয়োজন হবে, তখন এ সক্ষমতা কাজে লাগানো যাবে। তা না হলে প্রতিবারই তো তাদের বালি ফেলার জন্য কৃষিজমিই বেছে নিতে হবে।
আসন্ন দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বিবেচনায় নিয়ে হলেও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষকে কৃষিজমি থেকে নজর ফিরিয়ে নেয়া উচিত বলে মনে করেন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি থাকবে না। অন্যদিকে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ তিন ফসলি জমি অনাবাদি করার সিদ্ধান্তে অনড়। এটা কৃষকদের সঙ্গে এক ধরনের উপহাস। কৃষকরাই অর্থনীতির প্রাণ। তারা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কার স্বার্থে কৃষকদের দাবিকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।