দূষণে নিঃস্ব বেলাই বিল, ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গাজীপুরের চার উপজেলা লাগোয়া বেলাই বিল। কৃষি, দেশীয় মাছ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য—যেদিক থেকেই বিবেচনা করা হোক, এই বিলের গুরুত্ব অপরিসীম। কলকারখানার তরল বর্জ্য, ক্ষতিকর পদার্থের কারণে বিলটি এখন চরম মাত্রায় দূষণের শিকার। এই বিলের পানিদূষণে জড়িত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ কারণে বিল থেকে যেমন দেশি জাতের মাছ হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি শ্রীহীন হয়ে পড়ছে।

স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিলটির আয়তন প্রায় ৪০ বর্গকিলোমিটার। গাজীপুর সদর, কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ ও শ্রীপুর উপজেলায় বিস্তৃত। এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষের কৃষিজমি রয়েছে এখানে। এখানে ধান চাষ করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন। এ ছাড়া বর্ষাকালে আগে এই বিলে ঘুরে বেড়াতে পর্যটক আসতেন। মাছ ধরার জন্য জেলেরা আসতেন। দূষণের কারণে এসব কেবলই স্মৃতি।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিলটির মাঝখানে দুটি বড় খাল আছে। খাল দুটি বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে গিয়ে মিলিত হয়েছে তুরাগ, চিলাই ও বালু নদের সঙ্গে। আর এসব নদে টঙ্গী, বোর্ডবাজার, জয়দেবপুর, রাজেন্দ্রপুর ও শ্রীপুর এলাকার ৪০০ থেকে ৫০০ শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেলে দূষণ বাড়ে। তখন কৃষিকাজে সমস্যা হয়। তা ছাড়া ওই সময় দূষিত পানির দুর্গন্ধে পর্যটকেরাও এখানে আসেন না।

কমেছে ধান উৎপাদন

গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার সামনে সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়ন। ইউনিয়নের জামুনা সড়ক ধরে আরও তিন কিলোমিটার সামনে এগোলেই বেলাই বিল। ওদিক দিয়ে সম্প্রতি বিলে গিয়ে দেখা যায়, বিলজুড়েই কচুরিপানা। কমতে শুরু করেছে পানি। দূষণের কারণে কালো হয়ে উঠছে পানির রং। কোনো নৌকার চলাচল নেই। নেই মাছ শিকারিদের হাঁকডাক।

স্থানীয় কয়েকজন কৃষক কচুরিপানা সরিয়ে জমি প্রস্তুত করছেন বোরো ধান চাষের জন্য। কথা হয় তাঁদেরই একজন ষাটোর্ধ্ব প্রতিপদ দাসের সঙ্গে। তাঁর মূল পেশা কৃষিকাজ। বিলে প্রায় আট বিঘা জমি রয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকে প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ধান পেতেন ২৪ থেকে ২৫ মণ। কিন্তু ২০০০ সালের দিক থেকে বিলের পানিতে দূষণ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাতে কমতে থাকে ফলন। বর্তমানে বিঘাপ্রতি গড়ে ধান পান ১৩ থেকে ১৪ মণ।

উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা জানালেন আরও অনেক কৃষক। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিলে শুষ্ক মৌসুমে দূষিত পানির কারণে ধানের চারা মরে যায়। আবার বড় হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধান হয় না। পোকা বা আগাছায় ভরে যায় পুরো খেত। এর ফলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায় না।

আগের মতো মাছ নেই

বিলটি স্থানীয় লোকজনের কাছে দেশীয় মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। রুই, কাতলা, কৈ, শিং, মাগুর, পুঁটি, মেনি, টাকি, শোল, টেংরাসহ পাওয়া যেত নানা প্রজাতির মাছ। এই বিলে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন অনেকে। কিন্তু দূষণের কারণে বিলটিতে দিন দিন এসব মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের গাজীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পুরো জেলায় মোট মাছের চাহিদা ৬০ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ ও ২০২১ অর্থবছরে গাজীপুরে উৎপাদিত হয় ৫৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ। এর মধ্যে মুক্ত জলাশয়ে উৎপাদিত হয় প্রায় ১৯ হাজার মেট্রিক টন। তবে বেলাই বিলে কী পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়, এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে কর্মকর্তাদের দাবি, মুক্ত জলাশয়গুলোতে মাছের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমছে।

বেলাই বিলের মাছ প্রসঙ্গে কথা হয় কালীগঞ্জ উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের জেলে বিশেস্বর চন্দ্র দাসের (৩৫) সঙ্গে। তিনিসহ সাতজনের একটি দল প্রতি রাতে বিলে জাল ফেলে মাছ ধরতেন। পাঁচ-ছয় বছর আগেও গড়ে মাছ পেতেন ৩৫ থেকে ৪০ কেজি। সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে একেকজন ভাগে পেতেন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। সেই আয়েই চলত তাঁদের সংসার। দূষণের কারণে কয়েক বছর ধরেই কমতে থাকে মাছের পরিমাণ। দুই বছর আগে পাওয়া যেত সাত থেকে আট কেজি। তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই সাতজনই জেলে পেশা ছেড়ে শুরু করেন দিনমজুরির কাজ।

বিশেস্বর বলেন, ‘বিলের পানির পচা গন্ধে মানুষই টিকবার পারে না, মাছ থাকব কেমনে। এইড্যা আমাগোর বাপ–দাদার পেশা। এইড্যা দিয়াই আমাগোর সংসার চলত। কিন্তু দুই বছর ধইর‌্যা জাল ফেললে কোনো মাছই উডে না। হেললাইগ্যা সবাই এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হইছে।’

প্রশাসনের নেই কার্যকর উদ্যোগ

বেলাই বিলে দূষণের বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তরসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে। এর মধ্যে দুটি দপ্তরই তাঁদের দায় চাপিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর। তাদের দাবি, পানির দূষণ রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুর কার্যালয়ের পরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, ‘বিলটি দূষণের বিষয়ে ইতিমধ্যে জেনেছি। দূষণ রোধে শিগগিরই আমরা মাঠে নামব। দূষণের মূল পয়েন্টগুলো শনাক্ত করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আমাদের লোকবলের সংকট রয়েছে। এ কারণে আমাদের প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পেরে উঠি না।’

 

আরো জানতে……

ঐতিহ্যবাহী বেলাই বিল দখল করে আবাসন প্রকল্প করছে তেপান্তর হাউজিং!

 

সূত্র: প্রথম আলো

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button