পাঁচ দিনের মাথায় কালীগঞ্জ থানার ওসি মিজানুর রহমানকে পার্বত্য অঞ্চলে বদলি

নিজস্ব সংবাদদাতা : যোগদানের পাঁচ দিনের মাথায় প্রশাসনিক কারণে কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে ট্যুরিস্ট পুলিশের পার্বত্য অঞ্চলে বদলি করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
রোববার (০২ এপ্রিল) পুলিশ সদর দপ্তর এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
জানা গেছে, পুলিশ সদর দপ্তর অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) কামরুল আহসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক কারণে কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) পরিদর্শক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও ডিএমপি’র পরিদর্শক মোঃ জাহিদুর রহমানকে ট্যুরিস্ট পুলিশের পার্বত্য অঞ্চলে বদলি করা হয়েছে।
নতুন কর্মস্থলে যোগদানের জন্য আগামী ০৫ এপ্রিলের মধ্যে বর্তমান কর্মস্থল থেকে ছাড়পত্র গ্রহণ করবেন। অন্যথায় ০৬ এপ্রিল থেকে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত (Stand Release) বলে গণ্য হবে।
উল্লেখ্য: গত ২৮ মার্চ (মঙ্গলবার) গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী শফিকুল আলম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে পরিদর্শক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে কালীগঞ্জ থানার ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ২৯ মার্চ (বুধবার) তিনি কালীগঞ্জ থানার যোগদান করেন। এর পাঁচ দিনের মাথায় তাকে পার্বত্য অঞ্চলে বদলি করা হলো।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এসআই আকসাদুদ জামানকে মালিবাগ থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন এবং জোরপূর্বক মুক্তিপণ বাবদ ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা আদায় করে ডিএমপি’র গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একদল সদস্য। ওই দলে ছিলেন পরিদর্শক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানও।
ওই ঘটনায় ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন আকসাদুদ।
পরবর্তীতে, ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ‘মুক্তিপণ’ লেনদেনের টেলিফোন কথোপকথনের অডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়া এই টেলিফোন কথোপকথনে আকসাদুদের স্ত্রীর সঙ্গে ডিবি কর্মকর্তা কায়সার রিজভীকে বলেন ‘১ কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই। আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না?’
ঘুষ লেনদেনের এই ঘটনা ঘটেছিল এসআই আকসাদুদ জামান এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তার মধ্যে।
অভিযুক্ত হলো, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল তৎকালীন এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশি, ডিবির পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, এসআই মাসুদুল ইসলাম, এএসআই প্রকাশ চন্দ্র গুহ ও জুলহাস এবং কনস্টেবল মাসুদ রানা।
ওই টেলিফোন আলাপচারিতায় ছিপাঁচ দিনের মাথায় কালীগঞ্জ থানার ওসি মিজানুর রহমানকে পার্বত্য অঞ্চলে বদলিলেন বর্তমানে সিআইডির চাকরিচ্যুত উপপরিদর্শক (এসআই) আকসাদুদ জামানের স্ত্রী তাহমিনা ইয়াসমিন এবং ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কায়সার রিজভী কোরায়েশি। প্রায় এক বছর তদন্ত করে এ ঘটনার সত্যতা পায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তাতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সিআইডির এসআই আকসাদুদ জামানকে মালিবাগ থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন এবং জোরপূর্বক মুক্তিপণ বাবদ ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা আদায় করার সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ডিবির সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে তদন্ত কমিটি।
যেভাবে মুক্তিপণ আদায়
২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েন দুবাইপ্রবাসী রোমান মিয়া। ফুফাতো ভাই মো. মনির হোসেনকে নিয়ে তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যাচ্ছিলেন। কাওলা পদচারী–সেতুর কাছে মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল দিয়ে তাঁদের পথ আটকানো হয়। মনিরকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে ডিবি পরিচয় দিয়ে রোমান মিয়াকে মাইক্রোবাসে তুলে নেন দুর্বৃত্তরা। তাঁর হাতে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে তাঁর কাছ থেকে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার ও দুই হাজার দিরহাম (সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুদ্রা) ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে রামপুরা এলাকায় ফেলে যান দুর্বৃত্তরা। পরদিন এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন রোমান। ওই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। মামলার তদন্ত–তদারক কর্মকর্তা ছিলেন এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশি।
সূত্র বলছে, তদন্তে প্রবাসী রোমান মিয়াকে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া ও ডাকাতির ঘটনায় এসআই আকসাদুদ জামানসহ নয়জন জড়িত থাকার তথ্য–প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
এসআই আকসাদুদ জামান ওই সময় সিআইডিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং–এর মাধ্যমে প্রতারণার একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তিনি মাদারীপুর–শরীয়তপুরভিত্তিক একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সন্ধান পান। এই চক্র হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করছে বলে তিনি জানতে পারেন। তখন সিআইডি থেকে তাঁকে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে তদন্ত করার আদেশ দেওয়া হয়। এরপর খোঁজ নিয়ে রোমান মিয়ার বিষয়ে জানতে পারেন। আকসাদুদের অভিযোগ, রোমান মিয়ার সঙ্গে কায়সার রিজভীর পূর্বপরিচয় থাকায় মামলাটি তদন্তের ভার ডিবিতে নিয়ে আসেন তিনি। কায়সার রিজভী তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল টিমে ছিলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুদকে তুলে নেওয়া ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেটা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সকালে আকসাদুদ সিআইডি কার্যালয়ে যাওয়ার পথে মালিবাগ মোড়ে পৌঁছালে তাঁকে কায়সার রিজভীসহ তাঁর দলের সদস্যরা আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে বলা হয়, কাওলায় প্রবাসী রোমান মিয়ার অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আরও পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁরা এ ঘটনায় আকসাদুদের নাম বলেছেন। একপর্যায়ে অভিযোগ থেকে তাঁদের রেহাই দেওয়া নিয়ে কথা হয়। কায়সার রিজভী কোরায়েশি দুই কোটি টাকা চান। এ সময় কায়সার রিজভীর ফোন দিয়ে হোয়াটসআ্যাপে আকসাদুদ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। পরে আটক ব্যক্তিদের সবাইকে মুঠোফোনে তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়। কথামতো সবাই আকসাদুদের বাসায় টাকা রেখে যান। আকসাদুদ দিয়েছিলেন ৩৩ লাখ টাকা, আর বাকি ৫ জন দেন ৯৫ লাখ টাকা। ওই দিন সন্ধ্যার পর আকসাদুদকে সঙ্গে নিয়ে খিলগাঁও ঝিলপাড় এলাকায় তাঁর বাসায় গিয়ে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা নিয়ে আসেন কায়সার রিজভীসহ তাঁর টিমের সদস্যরা। তখন আকসাদুদকে আবার ডিবি অফিসে আনা হয়। পরে তাঁর স্ত্রী কায়সার রিজভীকে আরও ১৪ লাখ টাকা দেন। এরপর ২৮ নভেম্বর আকসাদুদ ছাড়া পান।
তবে মামলা চলতে থাকে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হাসান রাজা। তিনি পরবর্তী সময়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে রোমান মিয়াকে তুলে নিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আকসাদুদও জড়িত বলে উল্লেখ রয়েছে।
এ ঘটনায় ডিবির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট আকসাদুদ জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিআইডি। এর কয়েক দিনের মাথায় ৩১ আগস্ট কায়সার রিজভী কোরায়েশিসহ ডিবির ওই সাত সদস্যের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন আকসাদুদ। এর সপ্তাহ না যেতেই ৮ সেপ্টেম্বর আকসাদুদের স্ত্রীর সঙ্গে ডিবি কর্মকর্তা কায়সার রিজভীর ‘মুক্তিপণ’ লেনদেনের টেলিফোন কথোপকথনের অডিও ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন রাতে রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে আকসাদুদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। পরে তাঁকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। আকসাদুদ বর্তমানে ওই মামলায় জামিনে আছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরও এ ঘটনা তদন্তে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মোহাম্মদ আতাউল কিবরিয়ার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল।