নীতিমালা লঙ্ঘন : ‘কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ’ বন্ধ করেছে প্রশাসন, তবু চলছে কার্যক্রম!

নিজস্ব সংবাদদাতা : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পরিচালিত ‘কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ’ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন । এরপরও গোপনে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে অবৈধ কলেজ কর্তৃপক্ষ। চলছে পুনরায় চালু করার অপচেষ্টা। এ নিয়ে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
‘শীঘ্রই আবার কলেজ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। এ বিষয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অপু বণিক।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, কালীগঞ্জের বেশ কয়েকটি কলেজে প্রায় দুই শতাধিক আসন ফাঁকা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা চাইলে আসন ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে সে সকল কলেজে (ট্রান্সফার হয়ে) ভর্তি হতে পারবে। এছাড়াও মূল কলেজেও নিয়মিত ক্লাস এবং পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। এ বিষয়ে সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন ঘোড়াশাল মুসা বিন হাকিম ডিগ্রি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কালীগঞ্জ পৌরসভা সংলগ্ন এলাকায় তিন তলা বিশিষ্ট একটি ভবনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীতই ২০২২ সালে ‘কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেন অপু বণিক নামে স্থানীয় এক যুবক। এরপর ঘোড়াশাল মুসা বিন হাকিম ডিগ্রি কলেজের (EIIN:১১২৭৫৭) সঙ্গে কোড শেয়ারিং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করা হয়। ২০২২ শিক্ষাবর্ষে একাদশে শ্রেণীতে ১০৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করে ক্লাস শুরু করেন। বর্তমানে তাদের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলমান রয়েছে। এছাড়াও চলতি শিক্ষাবর্ষে এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীর ভর্তির প্রক্রিয়া (অনলাইনে আবেদন) সম্পন্ন করে ভর্তির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসকল শিক্ষার্থী ঘোড়াশাল মুসা বিন হাকিম ডিগ্রি কলেজে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ থেকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে এবং নতুনদের ভর্তি কার্যক্রম চলছে। সম্প্রতি কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার দেখতে পান তাদের সকল কিছুই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা হয়েছে। যা বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) স্থাপন, পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদান নীতিমালা-২০২২ (সংশোধিত-২০২৩) লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও তাদের সকল কার্যক্রম অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করে অচিরেই প্রতিষ্ঠানটির পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন। এরপর গত ১০ সেপ্টেম্বর কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার। যদিও এরপরও গোপনে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রথমবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা নেয়া শুরু হয়েছে। এছাড়াও চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম চালু রেখেছে কৃর্তপক্ষ। এছাড়াও কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করছে যে শীঘ্রই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে তাদের কলেজ। এ বিষয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ব্যবস্থা করছেন বলেও জানান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অপু বণিক।
কালীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নূর-ই-জান্নাত ‘কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ’ পরিদর্শন পরবর্তী প্রতিবেদন দাখিল করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পর্যালোচনাঃ সরেজমিনে দেখা যায় বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় নাই। যে কারণে গণিতের শিক্ষক রসায়ন বিষয়ে পাঠদান করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটিতে খেলার মাঠ ও অতিরিক্ত কোন জায়গাও নাই এবং প্রতিষ্ঠানের ভবনটি প্রতিষ্ঠাতার পৈত্রিক সম্পত্তির উপর নির্মিত। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোন জমি নাই। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (নিম্ম মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) স্থাপন, পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদান নীতিমালা-২০২২ (সংশোধিত-২০২৩) এর পরিশিষ্ট ১ এর (১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক নতুনমহাবিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে মফস্বল এলাকার জন্য অন্য মহাবিদ্যালয় থেকে ৪ কি.মি. দূরত্বে থাকতে হবে। কিন্তু দেখা যায় কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজের ৪ কিলোমিটারের মধ্যে আরও ২ টি প্রতিষ্ঠান (সরকারি কালিগঞ্জ শ্রমিক কলেজ ও কালীগঞ্জ মহিলা ডিগ্রী কলেজ) অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটিতে বিজ্ঞান বিভাগ চালু থাকলেও কোন বিজ্ঞানাগার নাই। পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক নাই। কোন ব্যাংক একাউন্ট নাই । শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বেতন/সেশন চার্জ আদায় করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা একজন ছাত্র। অর্থাৎ সম্পূর্ণ বানিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে।
মন্তব্য ও সুপারিশ : যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লংঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী পাঠদান করছে সেহেতু অচিরেই প্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করা প্রয়োজন ।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) উম্মে হাফছা নাদিয়া স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে কলেজের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ পরিদর্শন প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। পরিদর্শন প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় কলেজের ইআইআইএন এবং পাঠদানের স্বীকৃতি কোনটাই নেই। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না। এছাড়া বিজ্ঞান বিভাগ চালু থাকলেও বিজ্ঞানাগার নেই। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোন ব্যাংক একাউন্ট না থাকায় আর্থিক কর্মকান্ড সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রতিষ্ঠানের নামে নিজস্ব কোন জমি নেই। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) স্থাপন, পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদান নীতিমালা-২০২২ (সংশোধিত) ২০২৩ এর পরিশিষ্ট ১ এর (১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক নতুন মহাবিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে মফস্বল এলাকার জন্য অন্য মহাবিদ্যালয় থেকে ৪ কি.মি. দূরত্ব থাকতে হবে। কিন্তু দেখা যায় কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজের ৪ কিলোমিটারের মধ্যে আরও ২টি প্রতিষ্ঠান (সরকারি কালীগঞ্জ শ্রমিক কলেজ ও কালীগঞ্জ মহিলা ডিগ্রী কলেজ) অবস্থিত। শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে অতিরিক্ত বেতন/সেশন চার্জ আদায় করা হয়েছে। এমতাবস্থায়, প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লংঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে বিধায় কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ এর পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।
কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজের অধ্যক্ষ সুনীল কুমার বণিক জানান, আমাদের কলেজে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে ১২ সেপ্টেম্বর। এছাড়াও চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমাদের কলেজে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায়িক শিক্ষা এই তিন বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
তিনি আরো বলেন, কলেজের অনুমোদন না থাকায় ঘোড়াশাল মুসা বিন হাকিম ডিগ্রি কলেজের সঙ্গে কোড শেয়ারিং-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি, পাঠদান এবং পরীক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কিছুদিন আগে কলেজের কার্যক্রম বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। এরপর কি হয়েছে তা আমি জানাতে পারছিনা, কারণ আমি ছুটিতে আছি।
কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অপু বণিক বলেন, আমাদের কলেজে প্রথমবর্ষে মোট ১০৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আমরা অনেক চেষ্টা চালাচ্ছি আবার কলেজ চালু করতে। ইউএনও’র কাছে তিন-চার বার গিয়েছি। উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছি। রাজনৈতিক নেতারা এবং চেয়ারম্যান আমাকে আশ্বস্ত করেছে কলেজ আবার চালু করার বিষয়ে। চেয়ারম্যান কাগজপত্র জমা নিয়েছেন। বলেছেন দেখবেন।
এ বিষয়ে জানতে কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন পলাশের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
ঘোড়াশাল মুসা বিন হাকিম ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান বলেন, কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে কোড শেয়ারিং এর প্রস্তাব নিয়ে আসলে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের সহায়তা করার জন্য আমরা রাজি হয়েছি। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নতুন কলেজ করার শুরুতে কোড থাকে না । সে ক্ষেত্রে অন্য কলেজের কোড শেয়ারিং এর রেওয়াজ রয়েছে। সে অনুযায়ী আমারও কোড শেয়ারিং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করার জন্য রাজি হয়েছি। সে সময় জানা ছিলোনা তাদের এত সমস্যা রয়েছে। তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
তিনি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, যেহেতু শিক্ষার্থী আমার কলেজের অধীনে ভর্তি হয়েছে তাই তাদের আশ্বস্ত করে জানাচ্ছি ভয়ের কিছু নেই। সকলেই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। আমাদের ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা রয়েছে। তাই যে কেউ চাইলে আমাদের নিজস্ব ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে ক্লাসে অংশ নিতে পারবে। এছাড়াও তারা নিজেরাও সরাসরি এসে ক্লাস শুরু করতে পারে। এছাড়াও কেউ যদি ট্রান্সফার নিয়ে অন্য কলেজে যেতে চায় সে সুযোগও রয়েছে। এরপরও যদি কেউ কোন ক্ষতির সম্মুখীন হয় তার দায়ভার কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের সার্বিক সহায়তা করবো।
তিনি আরো বলেন, কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক এবং করণীয় নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নূর-ই-জান্নাত বলেন, কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ পরিদর্শন শেষে মন্তব্য এবং সুপারিশ প্রতিবেদন আকারে দাখিল করা হয়েছে। পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কলেজ কর্তৃপক্ষকে কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আজিজুর রহমান বলেন, সরকারি নীতিমালা লঙ্ঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পরিচালনা করা হচ্ছিল কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ। উপজেলা শিক্ষা অফিসার ওই কলেজ পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কালীগঞ্জ সেন্ট্রাল কলেজ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপরও কার্যক্রম চললে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।