পুরনো প্রযুক্তিতে শাহজালালে কুয়াশায় বিঘ্নিত হচ্ছে উড়োজাহাজ অবতরণ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঘন কুয়াশায় উড়োজাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হয়ে আবার আলোচনায় এসেছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আকাশ পরিবহন সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি শীতেই রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত একাধিকবার বন্ধ থেকেছে উড়োজাহাজ চলাচল। অন্যদিকে ঢাকায় নামতে না পেরে প্রতিবেশী ভারত কিংবা দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরে ফ্লাইট ঘুরিয়ে (ডাইভার্ট) দেয়ার একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। এসবের মূলে রয়েছে বৈরী আবহাওয়ায় উড়োজাহাজ অবতরণের পুরনো প্রযুক্তি ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম বা আইএলএস-১। কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ায় উড়োজাহাজ অবতরণ করতে বিশ্বের উন্নত বিমানবন্দরগুলো যেখানে আইএলএস-৩ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, সেখানে শাহজালালে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে আশির দশকে স্থাপিত আইএলএস-১ প্রযুক্তি। আকাশ পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টার্মিনাল-৩-এর মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে শাহজালাল বিমানবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, বিমানবন্দরের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ততটা গুরুত্ব পায়নি। ফলে প্রতি শীতেই বিঘ্নিত হচ্ছে উড়োজাহাজ চলাচল। এতে আকাশ পরিবহন সংস্থাগুলোর পরিচালন ব্যয় যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি দুর্ভোগে পড়ছেন যাত্রীরা।

সাধারণত খালি চোখে রানওয়ের অবস্থান শনাক্ত করে উড়োজাহাজ অবতরণ করেন বৈমানিকরা। অবতরণের জন্য ন্যূনতম ৫০০ মিটার দৃষ্টিসীমা প্রয়োজন হয়। কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ার কারণে দৃষ্টিসীমা কমে এলে রানওয়ের অবস্থান শনাক্তের জন্য ব্যবহার করা হয় আইএলএস প্রযুক্তি। শাহজালালে স্থাপিত আইএলএস-১ প্রযুক্তি কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন আকাশ পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা।

ভারতের কলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকার নিকটতম বিমানবন্দরগুলোর একটি। ২০১৮ সালে দেশটির পঞ্চম বিমানবন্দর হিসেবে আইএলএস-৩ (বি) প্রযুক্তি স্থাপিত হয় কলকাতায়। ফলে ৫০ মিটার দৃষ্টিসীমার মধ্যেও উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারে এ বিমানবন্দরে। এর আগে ভারতের দিল্লি, জয়পুর, লক্ষ্ণৌ ও অমৃতসর বিমানবন্দরে স্থাপন করা হয় একই ক্যাটাগরির আইএলএস।

কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ায় উড়োজাহাজ অবতরণের জন্য পাকিস্তানের ইসলামাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যবহার করা হয় আইএলএস-৩ প্রযুক্তি। ফলে পাইলটের দৃষ্টিসীমা ১০০ মিটারের মধ্যে থাকলেও এ বিমানবন্দরে অবতরণে কোনো সমস্যা হয় না। আর লাহোরের আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যবহার হয় আইএলএস-৩ (বি) প্রযুক্তি।

প্রতিবেশী দেশগুলো উন্নত প্রযুক্তির আইএলএস ব্যবহার করলেও বাংলাদেশ এখনো আছে পুরনো প্রযুক্তিতেই। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের আইএলএস প্রযুক্তি ক্যাটাগরি-১ থেকে ক্যাটাগরি-২-এ উন্নীত করার কাজ চলছে। একই ধরনের প্রযুক্তি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কক্সবাজার বিমানবন্দরেও।

শাহজালাল বিমানবন্দরের আইএলএস প্রযুক্তি আধুনিকায়ন সম্পর্কে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ মফিদুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘ক্যাটাগরি-২-এ উন্নীত হলে কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ায় উড়োজাহাজ চলাচলের এ সমস্যা আর থাকবে না।’

তিনি বলেন, ‘শাহজালালে আমরা নতুন একটি আইএলএস প্রতিস্থাপনের কাজ করছি। তবে কিছু কাজ বাকি থাকায় এ শীতে আমরা নতুন প্রযুক্তিটি ব্যবহার করতে পারব না। আগামী বছর থেকে আমরা আইএলএস-২ প্রযুক্তির সুফল পেতে শুরু করব।’

বর্তমানে কুয়াশার কারণে উড়োজাহাজ থেকে রানওয়ের দৃষ্টিসীমা ১৫০০ মিটারের নিচে নেমে গেলেই শাহজালালে উড়োজাহাজ অবতরণের সমস্যা হওয়ার কথা জানিয়েছেন আকাশ পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বর্তমানে শাহজালালের এ প্রযুক্তিটি ক্যাটাগরি-২-এ উন্নীত করা হচ্ছে। এটা হয়ে গেলে ৩০০-৪০০ মিটার দৃষ্টিসীমার মধ্যেও উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারবে। তবে ঘন কুয়াশা বা বৈরী আবহাওয়ায় অনেক সময় বৈমানিকের দৃষ্টিসীমা ৫০ থেকে শূন্য মিটারে নেমে আসে। তখন আইএলএস-২ প্রযুক্তি আর কাজ করে না। প্রয়োজন হয় আইএলএস-৩ প্রযুক্তির।

শাহজালাল বিমানবন্দরের আইএলএস প্রযুক্তির উন্নয়নে বেবিচকের যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করেন আকাশ পরিবহন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এখানে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের গাফিলতির ব্যাপার আছে। কারণ সমস্যাটা বছরের পর বছর ধরে চলছে। এর অবসান হওয়া দরকার। একেকটা ফ্লাইট ডাইভার্ট করলে সিভিল এভিয়েশনের কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু এয়ারলাইনসগুলো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাদের অনওয়ার্ড কানেকশন থাকে, তারা কানেকশন মিস করে। যারা বিদেশ থেকে আসে, তারা নাজেহাল হয়। কাজেই এটা সবার জন্যই ক্ষতিকর, একমাত্র সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ছাড়া। কারণ কোনো ফ্লাইট বিমানবন্দরে না নামতে পারলে বা ২ ঘণ্টা পরে নামলে তাদের কিছু আসে-যায় না।’

আইএলএস প্রযুক্তিকে একটি বিমানবন্দরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা প্রযুক্তিগতভাবে অনেক পিছিয়ে আছি। বলছি যে আমরা থার্ড টার্মিনাল করছি। কিন্তু এ টার্মিনাল করে লাভ কী, যদি ফ্লাইট ল্যান্ডই করতে না পারে?’

দ্রুততম সময়ে শাহজালালে আইএলএস-৩ প্রযুক্তি স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে কাজী ওয়াহিদুল আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বেবিচক এখন আইএলএস-২ স্থাপন করছে। সবচেয়ে ভালো হতো একবারে আইএলএস-৩ করতে পারলে। কিন্তু আইএলএস-২-এর কাজ শুরু করায় এখন আর সেটা সম্ভব না। তবে আমাদের দ্রুত আইএলএস-৩ প্রযুক্তির দিকে যেতে হবে।’

শাহজালাল বিমানবন্দরের পুরনো আইএলএস প্রযুক্তির কারণে প্রতি শীতেই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে আকাশ পরিবহন সংস্থাগুলো। ঢাকায় একটি উড়োজাহাজ অবতরণে ব্যর্থ হয়ে অন্য বিমানবন্দরে গেলে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অ্যারোনটিক্যাল চার্জ। জ্বালানি বাবদ খরচ হচ্ছে বাড়তি অর্থ। অনেক সময় যাত্রীর খাবার এবং হোটেলেরও প্রয়োজন হচ্ছে। এ খাতেও লাগছে বাড়তি অর্থ।

ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলামের মতে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আকাশ পরিবহন সংস্থাগুলো বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে। পরিচালন ব্যয় বেড়ে যায়। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়ে উড়োজাহাজ সেবার ওপর।

তিনি বলেন, ‘আকাশ পরিবহন সংস্থাগুলোরও কিন্তু একটা সীমাবদ্ধতা আছে। সকালের ফ্লাইটগুলো কুয়াশার কারণে দেরি হলে তার প্রভাব দিনের অন্য ফ্লাইটেও পড়ে। শিডিউল বিপর্যয়ের মতো ঘটনা ঘটে।’

শাহজালাল বিমানবন্দরের পুরনো আইএলএস প্রযুক্তির কারণে আকাশ পরিবহন সংস্থাগুলো বছরে অন্তত দুই মাস কঠিন সময় অতিক্রম করে বলে জানিয়েছেন জিএসএ-এয়ার এশিয়া ও টাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোরশেদুল আলম চাকলাদার। এ প্রসঙ্গে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরের এ প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে প্রত্যেক শীতে আমাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে দুইটা মাস (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) আমরা খুব কঠিন সময় পার করি। যাত্রীদের তো কষ্ট আছেই। বিভিন্ন সময় ইন্ডিয়ায় ল্যান্ড করতে হচ্ছে। তারপর কস্টিং বাড়ে, হোটেল খরচ আসে। সবকিছু মিলিয়ে কঠিন সময় যায় আমাদের।’

বর্তমানে প্রায়ই কুয়াশার কারণে রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন এয়ারপোর্ট ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বন্ধই থাকে। কুয়াশার কারণে এ সময়ে শাহজালালে কোনো ফ্লাইট ল্যান্ড করতে পারে না। ৬টার পর থেকে আবার ল্যান্ডিং শুরু হয়। এর ফলে দুপুরের দিকে অনেক চাপ বেড়ে যায়। রাত ১২টা থেকে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় ফ্লাইটগুলো রিশিডিউল করতে হয়।’

 

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button