বাংলাদেশি পাসপোর্টে সৌদিতে ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা, নবায়নে ‘উভয় সংকট’

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে অনেকের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। সে সময় থেকেই পাসপোর্ট নবায়নে অব্যাহতভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে।

রিয়াদের দেওয়া তালিকা বলছে— পাসপোর্টের মেয়াদ নেই; এমন ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা তৈরি করেছে সৌদি সরকার। যাদের পাসপোর্ট নবায়নের জন্য বাংলাদেশকে চাপ দেওয়া হচ্ছে ২০১০ সাল থেকে।

দেশটির অব্যাহত চাপে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। গেল রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় পাসপোর্ট নবায়ন কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান রিয়াদের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ সময় আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, সৌদি আরবের তালিকায় থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা যেহেতু বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদিতে গিয়েছে; সেহেতু তাদের পাসপোর্ট রিনিউ করে দেব। তবে তাদের নাম-ঠিকানা যেমন আছে; তেমনই থাকবে।

তবে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তে দেশের জন্য ‘উভয় সংকট’ দেখছেন সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন— সৌদি আরবে অস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য দু’ধারী তলোয়ারের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। সহজ করে বললে- ‘উভয় সংকট’।

বাংলাদেশি পাসপোর্টে সৌদিতে রোহিঙ্গারা
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নিতে রাজি হয়েছিল সৌদি সরকার। সে সময় বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদিতে পাড়ি জমায়। তখন পাকিস্তানে থাকা কিছু রোহিঙ্গাও একই প্রক্রিয়ায় সৌদি আরব যায়। রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের নাগরিক হলেও; অভিবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হয় বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে।

দেশটির দূতাবাসের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৯০-এর দশকের শেষে ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা সৌদি আরব গিয়েছিল। সেখানে তাদের শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

গোলাম মসীহ একজন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। সৌদি আরবের সাবেক এই কূটনৈতিক বলেছেন, রোহিঙ্গাদেও দেওয়া পাসপোর্টগুলো বাংলাদেশিদের মতোই সাধারণ ছিল। বিশেষ কিছু যুক্ত ছিল না তাদের পাসপোর্টে।

তিনি জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ৭৫-৭৬ এর সময়ে একবার গিয়েছে, ৮৩-৮৪ তে একবার গিয়েছে, ৯৩-৯৪তে একবার গিয়েছে। তখন অল্প সংখ্যক ওখানে গেলেও আস্তে আস্তে তাদের ছেলে মেয়ে হয়েছে, ফ্যামিলি বড় হয়েছে।

তার সময়ে, অর্থাৎ ২০১৭ সালের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, আমি দায়িত্ব নিয়েই জানতে পারলাম ৩৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়ন হয়নি। তাদের পাসপোর্ট নবায়ন না হলে এক ধরনের ক্রাইসিস থাকে। কেননা তাদের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করতে পারে না, বিদেশে যেতে পারে না। নানা সমস্যা রয়েছে এটি নিয়ে।

আসিফ মুনীর একজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, সৌদি আরব যখন তাদের নিতে চেয়েছিল; তখন পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছিল সৌদিতে থাকার জন্যই। কিন্তু এখন সেটি নবায়ন করে বাংলাদেশে নাগরিক হওয়া যাবে কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

তিনি বলছেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর— কারণ তাদের কাছে যে পাসপোর্ট রয়েছে, সেটা আমাদের বৈধ পাসপোর্ট। সেই বৈধ পাসপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কর্তৃপক্ষের একটা জবাবদিহিতার জায়গা আছে।

সৌদি আরবের অব্যাহত চাপ
প্রায় চার যুগ আগে বাংলাদেশি পাসপোর্টে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে পাড়ি জমান মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা। তাদের পাসপোর্ট নবায়নে ২০১০ সাল থেকেই বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে সৌদি আরব। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকা সফর করেন সৌদি সরকারের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসির বিন আবদুল আজিজ আল দাউদ। তখনও তিনি সে দেশে অবস্থানরত ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার হাতে পাসপোর্ট না থাকার কথা উল্লেখ করেন।

সৌদি আরবের পক্ষ থেকে তাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার অনুরোধও জানানো হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠক হয়। পরে সৌদি আরবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে একটি উচ্চ পর্যায়ে কমিটি বা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন হয়।

দেড় বছরের মাথায় আবারও দেশটির প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে একই বিষয় নিয়ে কথা বলে। রোববারের বৈঠকে তারা বাংলাদেশের কাছে স্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছে, ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়ন করতে কেন এতো সময় লাগছে?

ওইদিনই বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারা অনুরোধ করেছিলেন। আমরা গত বছর একটা সমঝোতা সাক্ষর করেছিলাম। সেটাতে আমরা স্লো যাচ্ছি কেন। আমাদের কোনো অসুবিধা আছে কি না; তারা জানতে চেয়েছেন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলেন, সৌদির একটা নিয়ম হচ্ছে, স্টেটলেস কেউ থাকতে পারবে না। হয় তাদের কাছে পাসপোর্ট থাকতে হবে, নয়তো আইডি কার্ড থাকতে হবে। সে কারণেই স্বাভাবিকভাবে তাদের পক্ষ থেকে এক ধরনের চাপ আছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন— বিভিন্ন সময় নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে এসব রোহিঙ্গা নাগরিকদের নাম আসছে। তারা আটক হলে দেখা যাচ্ছে তাদের অনেকেরই বৈধ পাসপোর্ট নেই। যেটি সে দেশের জন্য একটি বড় সংকট।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলছেন, যেহেতু আস্তে আস্তে সংখ্যায় বাড়ছে, সে কারণে সৌদি সরকার নিজেও তাদের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। তাছাড়া তারা যখন অপরাধ করছে, তখন বাংলাদেশের নাম আসছে। হয়তো সে কারণেই তারা বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে।

নবায়ন করবে বাংলাদেশ
সৌদি সরকারের কয়েক বছরের অনুরোধের পর অবশেষে সেদেশে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়ন করতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। সৌদি আরবের প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকের পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, তারা তখন বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিল। কাজেই আমরা শুধু নবায়ন করে দেবো।

সৌদিতে কর্মরত বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তারা এই বিষয়টিকে স্পর্শকাতর দাবি করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছেন— সৌদির নিয়ম হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রই স্টেটলেস থাকবে না। তাকে কোনো না কোনো একটা দেশের আইডেন্টিটি ধারণ করতে হবে। যে কারণে সৌদি আরব এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মসীহ বলছেন, যদি ভেরিফিকেশন করে পাওয়া যায় সে সত্যি বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকার স্বাভাবিকভাবে একটা স্টেপ তো নেবে। তবে কাজটি অনেক সময় সাপেক্ষ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আসিফ মুনীর বলেন, যেহেতু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক না। এখন তাদের পাসপোর্ট নবায়ন করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাথে আলাপ করে দ্বিপাক্ষিক কোনো সমাধানে আসা উচিত।

তবে নবায়ন করা হলে তাদের সৌদিতে রাখার বিষয়টিতে জোর দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন সাবেক কূটনীতিকরা। কারণ অনেকের আশঙ্কা রয়েছে, অপরাধে জড়িত বা সাজাপ্রাপ্ত অনেক রোহিঙ্গার কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকলে তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে।

‘উভয় সংকটে’ বাংলাদেশ
১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গারা সৌদি আরবে পাড়ি জমালেও তাদের পাসপোর্ট নবায়নের তাগিদ দেওয়া শুরু হয় মূলত ২০১০ সাল থেকে। তখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কম হলেও এখন আস্তে আস্তে সেটি বাড়তে শুরু করেছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলছেন, পরিবার বড় হওয়ার কারণে এই সংখ্যা বাড়ছেই। এই বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন— রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করলে নতুন করে তিনটি সংকট বাংলাদেশের সামনে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দাঁড়াবে। তাদের আশঙ্কা, পাসপোর্ট নবায়ন হয়ে গেলে সৌদি যদি কোনো কারণে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়; তাহলে তাদের গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে বাংলাদেশ।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আগে থেকেই সহমর্মিতার জায়গায় ছিল সৌদি আরব। আমার মনে হয় সেখান থেকে তারা সরে এসেছে। নবায়নের পর সৌদি থেকে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা বেশি।

তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলছেন, “সৌদি আরব নিশ্চিত করেছে, নবায়ন করা হলে তারা কাউকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না। সেক্ষেত্রে তাদের কাজের সুযোগ যেন হয়, অন্য কোনো সংকট যেন না হয়; সেই বিষয়টিও নজরে রাখতে হবে।

যদিও অন্য একটি কারণের দিকে বেশি জোর দিচ্ছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর। তিনি বলছেন, তাদের যখন পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছিল- রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে সৌদি যাওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছিল। এখন সেটি নবায়ন করা মানে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া। যেখানে দেশের মধ্যে ১২ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। কোনো কারণে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না।

কূটনীতিকরা মনে করছেন— এমন অবস্থায় রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়া হলে যে ১২ লাখ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে, তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ যে আলোচনা করছে আন্তর্জাতিক মহলে, সেখানেও সমস্যা তৈরি হতে পারে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে একবার স্বীকার করলে এই ৬৯ হাজার রোহিঙ্গাকে আর কোনোদিন মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে ওই ১২ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি হতে পারে।

আবার সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা, সেদেশে থাকা বিশাল শ্রমবাজার এবং আর্থিক সম্পর্কের কারণে তাদের অনুরোধ বাংলাদেশ ফেলতেও পারবে না। কারণ তা হলে শ্রমবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাহলে কি নবায়ন না করে এই ইস্যুর সমাধান সম্ভব?

এই প্রশ্নেও খুব একটা আশার আলো দেখছেন না অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। আসিফ মুনীর বলেন— এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার মাধ্যমে সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে বাংলাদেশকেই। ফলে সৌদি আরবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ দু’ধারী তলোয়ারের মুখে রয়েছে।

তার মতে, যদি আমরা তাদের কথা না শুনি; তাহলে তারা তাদের দেশে থাকা আমাদের দেশের নাগরিকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের রেস্ট্রিকশন আরোপ করতে পারে। অন্যদিকে যদি আমরা এটা মেনে নিই; তাহলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আমাদের যে অবস্থান সেটা সেটেল করতে পারবো না। কিন্তু ভবিষ্যতে সেই ঝুঁকি থাকলেও সৌদি আরবের অনুরোধ মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে সেটাই পরিষ্কার হয়েছে।

 

সূত্র: বিবিসি

Related Articles

Back to top button