‘অন্যের সন্তানকে নিজের দেখিয়ে’ কোটায় চাকরি, সেই মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে মামলা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বগুড়ার সোনাতলার রাণীরপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক উপজেলা কমান্ডার রফিকুল ইসলামের (৭২) বিরুদ্ধে সাত জনকে সন্তান সাজিয়ে তাদের কোটায় চাকরি পাইয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বগুড়া জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জাহিদ হাসান কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে তার ‘তিন সন্তানের’ বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেছেন।
প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় তিন জনকে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
শনিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে দুদক বগুড়া কার্যালয়ের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম সংবাদ মাধ্যমকে এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
অভিযোগ ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার সদর ইউনিয়নের রাণীরপাড়া গ্রামের মৃত ফয়েজ উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে। তিনি সোনাতলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার। রফিকুল ইসলাম ও রেবেকা সুলতানা দম্পতির দুই মেয়ে রাশেদা আকতার ও মোরশেদা আকতারের বিয়ে হয়েছে। রফিকুল ইসলাম মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে স্থানীয় কয়েকজনের সন্তানকে নিজের দেখিয়ে তাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করেন। ইতোমধ্যে সাত জনের নাম পাওয়া গেলেও তিনি তার সনদপত্র ব্যবহার করে আরও অনেককে সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন।
তার অপকর্ম থামাতে সোনাতলা উপজেলার রাণীরপাড়ার কেল্লাগাড়ি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও নিমের পাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার গত ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দেন।
তাদের অভিযোগ, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম একজন প্রতারক। তার এক স্ত্রী ও দুজন কন্যাসন্তান রয়েছে। অথচ তিনি সাত জনকে সন্তান সাজিয়ে তাদের কোটায় চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধারা এসব অপরাধে জড়িত রফিকুল ইসলাম ও কোটায় চাকরি পাওয়া তার কথিত সন্তানদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
এর মধ্যে সন্ধান পাওয়া তার বানানো সন্তানেরা হলেন সহোদর আহসান হাবিব ও জিয়াউর রহমান, বেলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেন, সালেক উদ্দিন, রাকিব হাসান এবং মৌসুমী আকতার।
হাবিব ও জিয়াউরের প্রকৃত বাবা সোনাতলার দক্ষিণ রাণীরপাড়ার জাফর আলী। এদের মধ্যে আহসান হাবিব মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে পুলিশে চাকরি পান। গাইবান্ধা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সে নায়েক পদে কর্মরত ছিলেন। মামলার পর তিনি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। জিয়াউর রহমানকে সারের ডিলারশিপসহ অন্যান্য সুযোগ করে দেন।
উপজেলার রাণীরপাড়ার মৃত জবেদ আলীর ছেলে বেলাল হোসেন। তাকে ২০০১ সালে পুলিশে চাকরির পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি ডিএমপির ট্রাফিক জোনের এটিএসআই পদে কর্মরত ছিলেন। মামলার পর সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। এ ছাড়া ফরহাদ হোসেন একই গ্রামের জাহিদুল ইসলামের ছেলে। তাকে ফায়ার সার্ভিসে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। মামলার পর তাকে গাইবান্ধার ফুলছড়ি ফায়ার সার্ভিস থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
একই গ্রামের নায়েব আলীর ছেলে সালেক উদ্দিন গত ২০০৫ সালে পুলিশ কনস্টেবল হন। পার্শ্ববর্তী জুমারবাড়ি এলাকার মোমিনুল ইসলামের ছেলে রাকিব হাসান চাকরি পেয়েছেন সমাজসেবা অধিদফতরে। তার ভাই শহিদুল ইসলামের মেয়ে মৌসুমী আকতারকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দুর্বল। এ সুযোগে রফিকুল ইসলাম বেশ কয়েকজনকে নিজের সন্তান সাজিয়ে কোটায় সরকারি চাকরি পেতে সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নেওয়া হয়। তিনি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ এই ‘সাইনবোর্ড’ সামনে রেখে নানা অপকর্মে জড়িত।
এদিকে অভিযোগ পাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তারা অনুসন্ধান শুরু করেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় দুদক বগুড়া কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক জাহিদ হাসান গত ৩০ জানুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ও তার তিন ভুয়া সন্তান বেলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেন ও আহসান হাবিবের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেন। মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নিয়ে বেলাল হোসেন এ পর্যন্ত ৫০ লাখ ১৮ হাজার টাকা বেশি সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া অন্য দুটি মামলায় আহসান হাবিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ৩২ লাখ ৫০ হাজার ও ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে নয় লাখ ৬৭ হাজার টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ফরহাদ হোসেনের বাবা জাহিদুল ইসলাম দাবি করেন, জন্মের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম তার ছেলেকে দত্তক নেন। লেখাপড়া ও লালন পালন করে বড় করেন এবং তাকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পেতে সহযোগিতা করেছেন। এতে দোষের কিছু নেই।
অভিযোগ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, তার দুটি মেয়ে রয়েছে। এরপরও তিনি দুই ভাতিজা বেলাল হোসেন ও ফরহাদ হোসেন এবং ভাগনে আহসান হাবিবকে সন্তান হিসেবে লালন পালন করেছেন। তিনি তাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। অন্য আর কাউকে কোটায় চাকরি বা অন্য কোনও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেননি। কাউকে কলেজ ভর্তিতে সহযোগিতা করেননি। কিছু মানুষ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি দুদকের ওইসব মামলা আদালতে মোকাবিলা করবেন।
দুদক বগুড়া কার্যালয়ের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান দেখিয়ে কোটায় চাকরির দিয়েছেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও তিন কথিত সন্তানের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করা হয়েছে। অন্য অভিযোগগুলোর ব্যাপারেও তদন্ত চলছে।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন