দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে মরিয়া যুক্তরাজ্য!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : করোনা মহামারীর সময় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে চরম দুরবস্থার চিত্র ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় এই খাতের চরম দুর্নীতিবাজ, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের ক্রসফায়ারের দাবি উঠেছে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায়। নাগরিক সাংবাদিকতার কল্যাণে জঘন্য অপরাধী আর দেশের জনগণের অর্থ পাচারকারীদের নানা অপকর্মের কাহিনী প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের ঐসব বড় মাপের দুর্নীতিবাজ, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের সাথে কিছু নষ্ট আমলা, নামকরা কিছু মিডিয়ার কিছু অসৎ সাংবাদিক, কিছু নষ্ট রাজনীতিবিদ জড়িত। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের জেকেজি’র আরিফুল ও সাবরিনা, রিজেন্ট হাসপাতালের শাহেদ, স্বাস্থ্য দপ্তরের ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, ডিজিএইচএসএর ডা. ইকবাল কবীর, পূর্ত দপ্তরের রূপপুর পারমানবিক কেন্দ্রের বালিশ কেলেংকারির নায়করা তাঁদের অর্থের একটা বিরাট অংশ বিদেশে পাচার করেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। অনেকে বিদেশি পাসপোর্ট নিয়েছে বিনিয়োগ কোটায়, বা মিলিনিয়াম মাইগ্রেশন কোটায়। ইতোমধ্যে দুইজন দুর্নীতিবাজ চার্টার্ড বিমানে দেশ ত্যাগ করেছেন, বিদেশী পাসপোর্টের কল্যাণে। তাই দেশের প্রচলিত আইনে মামলা করে তাঁদের শাস্তি দেওয়া আর তাদের গড ফাদারকে খুঁজে বের করে দুর্নীতিতে লাগাম টেনে ধরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কম করে হলেও ১০ বছরেও তা করা সম্ভব হবে কি না সন্দেহ আছে। ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা, বেগম খালেদা জয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত দুর্নীতির মামলা তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরের ৪টি হোটেলে জোরপূর্বক বাংলাদেশি নারীদের আটকে রেখে ড্যান্সবারে নাচানো ও দেহব্যবসায় বাধ্য করানোর অভিযোগে বিএনপি নেতা আজম খানকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এসময় তার ২ সহযোগীকেও আটক করা হয়। মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুল নামের বাংলাদেশের একজন এমপি কুয়েতে গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধেও মানব পাচার সহ বিপুল অংকের টাকা পাচারের অভিযোগ আছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আইএমএফ বলছে, করোনার কারণে ২০০৮ -২০০৯ সালের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা। মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নামছে। অনেক দেশের এই ফল ভোগ করতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায় নিজের দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। ব্রিটেনের এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি ব্রিটেনের অর্থনীতিকে রেকর্ড গভীরতম মন্দার দিকে ঠেলে দেবে। যা হতে পারে প্রায় ৩০০ বছরে সবচেয়ে বড় পতন।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের হিসাব অনুযায়ী, ১৪ শতাংশ সংকুচিত হতে যাচ্ছে ব্রিটেনের অর্থনীতি। আর এটা জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় পতন। যা ১৯৪৯ সাল থেকে হিসেব রাখা হয়েছে।

আবার ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যান যদি ধরা হয়, তাহলে বেরিয়ে আসে ১৭০৬ সালের পর আর এত বড় পতন হয়নি ব্রিটেনের অর্থনীতিতে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, ব্রিটেনে নাটকীয়ভাবে চাকরি ও আয় কমতে যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকরা ব্যাংকে সুদের হার সর্বনিম্ন ০.১ শতাংশ করতে ভোট দিয়েছেন।

এটা বলার আগে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের অন্যতম প্রবক্তা, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা পাচারের অভয়ারণ্য যুক্তরাজ্য ২০০৮ -২০০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে কী করেছিল তার একটা উদাহরণ শেয়ার করতে চাই।

প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকার ফলে আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানা মানুষের সংখ্যা কম না, আবার ইংরেজি ভাষা শিক্ষার আগ্রহী মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশি। কারণ বিশ্ব যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজি অন্যতম একটি ভাষা। তাই শুধু অবিভক্ত ভারতের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মত দেশই নয়, রাশিয়া ও চীনের অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজি শেখায় আগ্রহী হয়ে পড়ে। ২০০৮ -২০০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে যুক্তরাজ্য ১২ এপ্রিল ২০১২ থেকে নতুন ভিসা নীতি চালু করে যাতে ভিসা ফি বাড়িয়ে বিশ্বের প্রায় ৩০ টি দেশের শিক্ষার্থী টানার জন্য এজেন্ট নিয়োগ করে। ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হয়, যুক্তরাজ্যের অলি গলিতে ১/২ রুমের স্কুল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশের মত দেশ থেকে আর্থিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল মানুষেরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের দলে দলে বিলেতে যান লেখাপড়া আর উন্নত জীবনের আশায়। কারণ বাংলাদেশী যারা ইংল্যান্ডে স্কুল কলেজ খুলে বসেন তারা শিক্ষার্থীদের স্পন্সর হন। কারণ পরিবর্তিত ভিসা নীতিতে পড়াশোনা করার সময় অবশ্যই কোর্স ফি এবং মাসিক জীবনযাত্রার ব্যয়গুলি কাটাতে পর্যাপ্ত টাকা রয়েছে তা অবশ্যই প্রদর্শন করতে হতো। এভাবেই আমাদের মত গরীব দেশগুলো থেকে হাজা হাজার কোটি পাউণ্ড তারা হাতিয়ে নিয়ে ভাষা শিক্ষা, ডিপ্লোমা কোর্স আর আণ্ডার গ্রেড করার পরে (৯৯% সেই যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন নি) ইউকে বর্ডার এজেন্সি (ইউকেবিএ) ছাত্রদের ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়।

এটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে অবশেষে ব্যাঙয়ের ছাতার মত গড়ে তোলা স্কুল কলেজের লাইসেন্স পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। এভাবেই তারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর জন্য শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এটার প্রভাব এখন বাংলাদেশে। অলি গলিতে গজিয়ে উঠেছে নানা নামের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, যাদের অনেকেই এখন শুধু সার্টিফিকেট বিক্রি করছে বলে অভিযোগ আছে।

এবার আসি করোনাভাইরাস মহামারি ব্রিটেনের অর্থনীতিকে রেকর্ড গভীরতম মন্দা সৃষ্টি করেছে তা থেকে মুক্তি পেতে তারা কী কী করছেন। গত ৫জুলাই যুক্তরাজ্য সরকার ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন-বিষয়ক অবরোধ বিধিমালা ২০২০ (গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস স্যাঙ্কশন রেগুলেশনস্ ) প্রকাশ করেছে। এর অধীনে দেশটির সরকার তাদের বিবেচনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত কাউকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও তাদের সম্পত্তি জব্দ করতে পারবে।

উন্নত দেশগুলোর কাল্পনিক অভিযোগ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন তথা গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত বলে তারা মনে করে। প্রবর্তিত বিধিমালার অন্যতম লক্ষ্য হলো, বিদেশে (ইউকে’র সীমানার বাইরে) সংঘটিত যেসকল “কর্মকাণ্ডে” কোনো ব্যাক্তির “বেঁচে থাকার অধিকার” অথবা “নির্যাতন-বা-নিষ্ঠুরতার-শিকার-না-হবার অধিকার, অমানবিক-বা-মর্যাদাহরণকারী-আচরণ-ও-শাস্তির-শিকার-না-হবার অধিকার” সমূহের “গুরুতর লঙ্ঘন” হবে, তেমন “কর্মকাণ্ড” “প্রতিহতের লক্ষ্যে বাধা প্রদান, এবং তার দায় গ্রহণ” নিশ্চিতকরণ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচার-বহির্ভূত হত্যা, গুম এবং নির্যাতন (টর্চার) অহরহ ঘটে থাকে, এবং অনেকক্ষেত্রেই এসব খবর সরকার ও দেশ বিরোধী পত্র পত্রিকায় অতিরঞ্জিত করে প্রকাশিতও হয়। এসব ঘটনায় প্রায়শই ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের আঙুল থাকে সরকার বা কোনো কোনো আইন প্রয়োগ সংস্থার দিকে।

অতীতে বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাজ্য তেমন কোনো বক্তব্য দেয়নি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, তাহলে এখন কেন? এটা কী তাঁদের অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর কৌশলের অংশ! কারণ, দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কর্তৃক ঘোষিত একটি নতুন নীতিমালার অধীনে স্নাতকোত্তর শেষে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা দুই বছর অবস্থান করতে এবং কাজ করতে সক্ষম হবে বলে টোপ দিয়েছেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা স্নাতক শেষ হওয়ার পরে কেবল চার মাসের জন্য যুক্তরাজ্যে থাকতে পারে, যা করা হয় ২০১২ সালের আইনে।

বাংলাদেশের মানুষ মনে করেন যে, জেকেজি’র আরিফুল ও সাবরিনা, রিজেন্ট হাসপাতালের শাহেদ, স্বাস্থ্য দপ্তরের ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, ডিজিএইচএসএর ডা. ইকবাল কবীর, যুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরের ৪টি হোটেলে জোরপূর্বক বাংলাদেশি নারীদের আটকে রেখে ড্যান্সবারে নাচানো ও দেহব্যবসায় বাধ্য করানোর অভিযোগে আটক বিএনপি নেতা আজম খান, মানব ও অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার পাপুল নামের বাংলাদেশের এমপি’র মত টাকা পাচারকারীদের টাকার দিকে কী ব্রিটিশ সরকারের নজর পড়েছে! কারণ এদের ক্রস ফায়ার দেওয়ার জন-দাবির মুখে সরকার নাজেহাল। এসময় ব্রিটিশ সরকারের এই আইন কী ইঙ্গিত বহন করে? তাঁদের অতীত ও নিকট অতীত খুব পরিষ্কার নয়। এখনো বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সহ উন্নয়নশীল দেশের অনেকেই জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ না থাকলেও শুধু জুয়া খেলার নামে তাঁদের পাচার করা টাকায় ব্রিটেনে রাজকীয় জীবন যাপন করছেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সেখানে বহাল তবিয়তে আছেন, তারা আবার সুশাসনের কথা বলছেন নতুন করে। পিছনে কি বাংলাদেশের জনগণের লুট করা টাকা সে দেশে পাচারের সুযোগ দিতে কী সরকারের উপর এটা পরোক্ষ চাপ! নিন্দুকেরা এমনটাই অনুমান করছেন, কারণ সেখানে বাংলাদেশের দুর্নীতির যুবরাজ ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ফাঁসি ও জেলের সাজা নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। মনে হয় পৃথিবীতে মাত্র দুটি মানুষের মানবাধিকার নেই, তাঁদের একজন হচ্ছেন, শেখ রেহানা, আরেকজন শেখা হাসিনা, যাদের পরিবারের সব সদস্য আর আত্মীয়দের বিচার বহির্ভূত ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। খুনিদের কেউ কেউ এখনো বিলেতে, আর তাই বিলেতি সরকারের এমন কথায় হতবাক হন অনেকেই যারা তাঁদের অতীত জানেন না।

 

লেখক: কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button