পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন করে হত্যা: ‘১০ লাখ টাকা দেবো, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিক’
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে এক যুবককে নির্যাতন করে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে৷পুলিশ তাড়া করলে সুইপার কলোনির এক ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন রায়হান। সেখান থেকে ধরে ফাঁড়িতে নেয়ার পর মৃতদেহ পাওয়া যায় হাসপাতালে।
শনিবার (১১ অক্টোবর) ভোরের দিকে এ ঘটনাটি ঘটে। রায়হানের পরিবারের দাবি, হত্যা করার পর পুলিশ তার পরনের কাপড়ও পাল্টে নেয়। এমনকি বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর পুলিশ প্রথমে দাবি করেছিল ছিনতাই করার সময় গণপিটুনিতে মারা গেছে রায়হান।
কিন্তু রায়হানের পরিবার পুলিশের হেফাজতে রায়হানকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ তোলার পর নড়েচড়ে বসেন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তেই বেরিয়ে আসে নির্যাতনের তথ্য।
সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার গুলতেরা মঞ্জিলের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে নিহত রায়হান। তিনি এক মেয়ে সন্তানের জনক। নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে এক চিকিৎসকের চেম্বারে চাকরি করতেন তিনি।
নিহতের স্ত্রীর মামলা
পুলিশ হেফাজতে স্বামী রায়হান উদ্দিনকে হত্যার অভিযোগ এনে কোতোয়ালি থানায় রোববার রাতে মামলা করেন নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। মামলায় কোনো এজহার নামীয় আসামি না থাকলেও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে টাকা চেয়ে রায়হান যে মোবাইল নাম্বার (০১৭৮ ৩৫৬১১১১) থেকে ফোন দিয়েছিলেন তা এজহারে উল্লেখ করা হয়। মামলায় ফাঁড়িতে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যাওয়াসহ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়। মামলার এজহারে বাদী আর উল্লেখ, কে বা কারা রায়হানকে ধরে নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে মারধর করার পাশাপাশি তার হাতের নখ তুলে ফেলে। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়েও রায়হানের শরীর ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ সূত্র জানায়, সিলেট মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (উত্তর) অফিসের স্মারক নং ৬৩৫৭ (১২ অক্টোবর) প্রাপ্ত হওয়ার পর পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ তৎসহ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারন) আইন ২০১৩-এর ১৫ (১), ২ (৩) এ মামলা রুজু করা হয়।
মায়ের বর্ণনায় রায়হান-হত্যা
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, ‘‘পুলিশ চেয়েছিল ১০ হাজার, তা আমি পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমার ছেলের লাশ দিয়েছে। এই পুলিশদের আমি এখন ১০ লাখ টাকা দেবো, তারা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিক।” তিনি বলেন, ‘‘শনিবার বিকেল ৫টার দিকে আমার ছেলে রায়হান ডিউটিতে যায় নেভি ব্লু কালারের প্যান্ট ও নেভি ব্লু কালারের শার্ট পরে। রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে বাসায় আসার কথা থাকলেও সে আসেনি। তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ভোর ৪টা ২৩ মিনিটের দিকে আমার মোবাইল ফোনে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে (০১৭৮ ৩৫৬১১১১) কল আসে। ফোনটি ধরেন রায়হানের সৎ পিতা হাবিবুল্লাহ। তখন রায়হান কান্নাকাটি করে জানায় পুলিশ তাকে ধরে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে এসেছে। কিছু টাকা দিয়ে দিলে তাকে কোর্টে না নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে। ওই মোবাইল নাম্বারটি ছিল পুলিশ কনস্টেবল তৌহিদের। সাথে সাথে রায়হানের বাবা প্রায় ৫ হাজার টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হন। ফাঁড়ির পাশের একটি মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি ফাঁড়িতে যান। তখন তাকে জানানো হয়, রায়হানকে যারা নিয়ে এসেছেন তারা ঘুমাচ্ছেন। রায়হানও ঘুমাচ্ছে৷ সাড়ে ৯ টার দিকে এলে পাবেন। এ সময় একজন পুলিশ তাকে ওই সময় ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলেন।’’
কিন্তু রায়হানের মা জানান, পরে টাকা নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ হয়নি, ‘‘টাকা নিয়ে ৯ টার দিকে ফাঁড়িতে গেলে তারা কেউ রায়হানকে নিয়ে কথা বলেন না। অপেক্ষা করার এক পর্যায়ে একজন পুলিশ জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সেখানে যাওয়ার পর শোনা যায় রায়হানের লাশ ওসমানী হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। আমার নিরপরাধ ছেলেকে পুলিশ টাকার জন্য নির্যাতন করে হত্যা করেছে। আমার ছেলেকে পশুর মতো নির্যাতন করে হাতের নখ তুলে ফেলা হয়েছে। তার পা, পিঠসহ শরীরের একাধিকস্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আমার ছেলে হত্যা বিচার চাই আমি।”
সন্তানের মৃতদের দেখার সময়টা এখনো তাঁর চোখে ভাসে, ‘‘আমার ছেলেক যখন হাসপাতালে দেখি তখন বুকটা ফেঁটে যায় নির্যাতনের আঘাত দেখে। বাসা থেকে সে যেসব কাপড় পরে গিয়েছিল, সেই সব কাপড় পরনে ছিল না। তার পরনে লাল রংয়ের একটি শার্ট আর অন্য একটি প্যান্ট ছিল। শার্টটি রায়হানের নয়৷ এটা পুলিশ দিয়েছে। আমার ছেলের মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন আমরা এখনও পাইনি।”
আসামিরা পলাতক
কিন্তু মামলার পর দ্রুত তদন্ত শুরু করা হলেও যাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তারা পুলিশের হেফাজত থেকে পালিয়ে গেছেন জেনে সন্তান হারানো বৃদ্ধা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তার মতে, ‘‘এতে প্রমাণ হয় পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা রয়েছে।”
আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য রায়হানের আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল৷মায়ের আফসোস, সবকিছু চূড়ান্ত থাকলেও ছেলে যেতে পারলো না।
রায়হানের সৎ পিতা হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘‘তারা আমার ছেলেকে যেভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের ফাঁসি চাই।”
জানা গেছে, রায়হানের পিতা ৯০ দশকে বিজিবিতে (তখন বিডিআর) চাকরি করতেন৷ রায়হানের দাদা চাকরি করতেন পুলিশে।
সেই রাতে যা ঘটেছিল
শনিবার (১১ অক্টোবর) রাতে যখন রায়হান উদ্দিন পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে সিলেট নগরীর কাষ্টঘর এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আশেক এলাহিসহ পুলিশের একটি দল তাকে অপরাধী সন্দেহে ধাওয়া করে। তখন পুলিশের ধাওয়া খেয়ে রায়হান ভয়ে কাষ্টঘর এলাকার সুইপার কলোনীর সুলাই লালের ঘরে আশ্রয় নেন। পরে ৪-৫জন পুলিশ রায়হানকে ওই ঘর থেকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ধরে নিয়ে যায়। সুলাই লাল বলেন, ‘‘এক যুবক রাত প্রায় ৩টার দিকে দৌঁড়ে এসে আমার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। পরে পুলিশ এসে তাকে ছিনতাইকারী বলে ধরে নিয়ে যায়।’’
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির লাগোয়া কুদরত উল্লাহ বোর্ডিংয়ের ১০২ নম্বর রুমে থাকেন ব্যবসায়ী হাসান আহমদ। তিনি জানান, রোববার রাতে এক আত্মীয়কে নিয়ে দক্ষিণ সুরমা কদমতলী এলাকার টার্মিনালে যান। সেখানে তাকে ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে বোর্ডিংয়ে ফিরেন। এ সময় তিনি ফাঁড়ির ভেতরে এক যুবকের কান্নাকাটি শুনতে পান। কান্নাকাটি করার সময় যুবকটি চোর কিংবা ছিনতাইকারী নয় বলে দাবি করলেও নির্যাতন থামেনি।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরানও মনে করেন রায়হান নিরপরাধ ছিল, ‘‘তার কোন দোষ নেই। তাকে ফাঁড়িতে রেখে পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে এলাকায় কারো কোনো অভিযোগ নেই।”
তদন্ত, প্রতিবেদন ও চার পুলিশকে বরখাস্ত/প্রত্যাহার
শনিবার (১১ অক্টোবর) রায়হানের মৃত্যু ঘটনা তদন্তে এসএমপি’র উপকমিশনার (ডিসি-উত্তর) আজবাহার আলী শেখের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন, এসএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (ক্রাইম দক্ষিণ) এহসানুদ্দিন চৌধুরী, অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম উত্তর) শাহরিয়ার আল মামুন ও সহকারী পুলিশ কমিশনার বিমানবন্দর থানা প্রভাশ কুমার সিংহ। তদন্ত কমিটির সুপারিশ পেয়ে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যাহার করা হয়েছে আরো তিন পুলিশ সদস্যকে। সোমবার (১২ অক্টোবর) মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ সাময়িক বরখাস্তরা হলেন, বন্দরবাজার ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস। প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন, এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।
হত্যার অভিযোগ, ‘শাস্তি’ বরখাস্ত অথবা প্রত্যাহার
জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ পুলিশের এএসআই ও কনস্টেবল কয়েকজনকে। প্রথমে রায়হানকে ফাঁড়িতে নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন এসআই আকবর। পরে সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে সেখান থেকে তথ্য নেয় তদন্ত কমিটি। ফুটেজ দেখানোর পর সবাই মুখ খুলতে শুরু করেন। পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরো জানান, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি লাগোয়া জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়। সেখান থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। শনিবার রাত ৩টা ৯ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে থামে৷সামনের অটোরিকশা থেকে তিন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে রায়হানকে দেখা যায়। তিনি হেঁটে পুলিশের সঙ্গে ফাঁড়িতে প্রবেশ করেন। এরপর সকাল ৬টা ২২ মিনিটে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আসে বন্দর ফাঁড়ির সামনে। এর দুই মিনিট পর ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে দুই পুলিশের কাঁধে ভর করে রায়হানকে সেই অটোরিকশায় তুলতে দেখা যায়।
অবশেষে তদন্তে পিবিআই
সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিহত রায়হান উদ্দিনের মামলা তদন্ত করছে পিবিআই। বুধবার (১৪ অক্টোবর) দুপুরে পিবিআই-এর একটি তদন্ত দল বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি পরিদর্শন করেছে। এ সময় তারা সিসি ক্যামেরা ও রায়হানকে যে কক্ষে রাখা হয়েছিল সেই কক্ষ পরিদর্শন করার পাশাপাশি দায়িত্বরতদের সাথে কথা বলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিলেট জেলা পুলিশ সুপার খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ সদরদপ্তরে পিবিআইকে মামলা তদন্তের জন্য সুপারিশ করা হয়। এরপর সেখান থেকে পিবিআই দপ্তরে তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি৷ তদন্তের পর সবকিছু জানা যাবে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ বলেন, পুলিশ তদন্ত করে যাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে, তাদেরকে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়াও এই মামলার সার্বিক তথ্য ইতোমধ্যে পিবিআইকে হস্তান্তর করা হয়েছে৷ এখন সবকিছু পিবিআই দেখবে। এসআই আকবর পুলিশের নির্দেশনা থাকার পরও আত্মগোপনে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের নির্দেশনা ছিল মহানগরী এলাকা না ছাড়ার জন্য৷ বিষয়টি আমাদের পাশাপাশি নতুন তদন্ত দল পিবিআইও তদন্ত করছে৷ এখন তারা কাকে গ্রেফতার করবে এটা তাদের বিষয়। ‘‘অপরাধ করলে শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে” বলে মন্তব্য করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোর্তিময় সরকার বলেন, পুলিশ ফাঁড়িতে যুবককে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ উঠায় তদন্ত কমিটি করে মহানগর পুলিশ। তদন্তের পর ৪ জনকে সাময়িক বরখাস্ত ও ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে