শহরাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ড : আগুন নেভানোর বাধা পদে পদে

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তাদের কাছে চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার খবর আসে রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে। টেলিফোনে এ সংবাদ পাওয়ার ২ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে রওনা দেয় ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট। সদর দপ্তরের কাছাকাছি আলাউদ্দিন সড়কের পুরোটা তখন যানজটে স্থবির। সরু রাস্তার যানজট ঠেলে চুড়িহাট্টায় যখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছায়, ঘড়ির কাঁটায় তখন ১১টা ছুঁইছুঁই। মাত্র দুই কিলোমিটারেরও কম রাস্তা পাড়ি দিতে দমকল কর্মীদের সময় লেগেছে প্রায় ২২ মিনিট। এর পর কাছাকাছি পানির কোনো উৎস না থাকায় তা সংগ্রহের জন্য যেতে হয় ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নাজিমুদ্দিন রোডের কারা সদর দপ্তরের পুকুরে। সব মিলিয়ে আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর দমকল কর্মীদের কাজ শুরু করতেই সময় লাগে আধা ঘণ্টারও বেশি।

ততক্ষণে আরো তীব্রতা পেয়ে আগুনের ভয়াবহতা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের প্রায় বাইরে। ওয়াহিদ ম্যানশন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের আরো চারটি আবাসিক ভবনে। এ আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে দমকল কর্মীদের সময় লেগেছে ১৫ ঘণ্টারও বেশি। এ সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলেই পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন ৬৭ জন। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরো চারজন।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক একেএম শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের জানান, চকবাজারের সরু রাস্তায় তীব্র যানজটের কারণে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে সময় লেগেছে বেশি। এর পর ঘটনাস্থলের আশপাশে কোথাও পানির ব্যবস্থা না থাকায় কাজ শুরু করতে আরো বিলম্ব হয়ে যায়। সময়মতো কাজ শুরু করা গেলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরো কমানো যেত।

রাজধানীসহ দেশের সব জেলা শহরেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পদে পদে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয় দমকল কর্মীদের, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ চকবাজারের চুড়িহাট্টার ঘটনাটি। আট বছর আগের ভয়াবহ নিমতলী ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রেও অগ্নিনির্বাপণ করতে গিয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসকে। বিনা বাধায় তাত্ক্ষণিকভাবে অগ্নিনির্বাপণের কাজ শুরু করা গেলে উভয় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকখানিই কমিয়ে আনা যেত।

আগুন নেভাতে গিয়ে দমকলকর্মীদের এভাবে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে ফায়ার সার্ভিসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও।

এতে বলা হয়, শহর এলাকায় অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাব, হাইড্রেন্টের (রাস্তার পাশে বসানো পানিপ্রবাহের উচ্চক্ষমতাযুক্ত কয়েকমুখী কল) অনুপস্থিতি, যানজট ও অপ্রশস্ত রাস্তাঘাটের কারণে সময়মতো আগুন নেভানোর কাজ শুরু করা যায় না। উপরন্তু আগুন ছড়ানোর বহুমাত্রিক ঝুঁকি (যেমন রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি, ফায়ার এক্সিটের অনুপস্থিতি ইত্যাদি), অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এবং বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে ভয়াবহতা বাড়ে অগ্নিকাণ্ডের।

যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই রেসপন্স টাইমিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান। তিনি বলেন, যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই কতটা দ্রুত সাড়া দেয়া যাচ্ছে, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর আগুনের ক্ষেত্রে তো এটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আগুন লাগার পর প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যে যদি রেসপন্স করা যায়, তাহলে সে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হয়ে থাকে। কিন্তু রেসপন্স টাইম যদি ১০ মিনিট ছাড়িয়ে যায়, তাহলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোয় যানজট ও প্রয়োজনীয় পানির সংকুলান না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগুন লাগার প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করা যায় না।

যানজটকে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতি বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হিসেবে দেখছে ফায়ার সার্ভিস। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগুনের খবর পেয়ে তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইউনিট নিয়ে বের হলেও যানজটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেন না। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের বেতার যন্ত্রের সঙ্গে (ওয়াকিটকি) পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের বেতার যন্ত্রের কোনো সংযোগ না থাকায় পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে যানজট এড়িয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানও অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

আগুনে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার আরেকটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ফায়ার হাইড্রেন্টের অনুপস্থিতি। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় দেখা যায়, আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে ফায়ার হাইড্রেন্ট। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এটি রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল, যার উচ্চতা হয় রাস্তা থেকে দু-তিন ফুটের মতো। বিশেষায়িত এ কলের নিচে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পানির পাম্প সংযুক্ত থাকায় একটি হাইড্রেন্ট থেকে মিনিটে দেড় হাজার গ্যালন পানি সরবরাহ করা সম্ভব। একটি ফায়ার হাইড্রেন্টে মুখ থাকে তিন-চারটি। এসব মুখে লাগানো প্লাস্টিকের ঢাকনা খুলে হোসপাইপ সংযুক্ত করে খুব সহজেই আগুন নেভানোর পানি নিতে পারেন দমকলকর্মীরা।

অগ্নিনির্বাপণসহ পানির জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাগুলোয় বেশকিছু ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার অভাবে এসব হাইড্রেন্ট এখন বিলুপ্ত। পরে ঢাকায় নতুন করে কোনো ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, ঢাকার কোনো এলাকায়ই হাইড্রেন্ট নেই। তবে ঢাকার বাইরে পুরনো কয়েকটি জেলা শহরে এখনো কিছু হাইড্রেন্ট দেখা যায়, যা ব্রিটিশ শাসনামলে স্থাপিত একমুখী হাইড্রেন্ট। সেগুলোও জরুরি প্রয়োজনের বদলে এলাকাবাসীর বাড়তি পানির চাহিদা মেটানোয় ব্যবহার হয়ে থাকে।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি এলাকা ও যেসব রাস্তায় অগ্নিনির্বাপক গাড়ি সহজে প্রবেশ করতে পারে না, মূলত সেসব এলাকায়ই ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করার কথা। কিন্তু ঢাকার কোনো এলাকায়ই কাজ করতে গিয়ে হাইড্রেন্টের দেখা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে এরই মধ্যে ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে কথা হয়েছে। তারাও জানিয়েছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোয় প্রাথমিকভাবে কিছু হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হবে।

রাজধানী ঢাকার তুলনায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তুলনামূলক বেশি ঘটে। অগ্নিকাণ্ডে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও সেখানে অনেক বেশি। কিছুদিন আগেও চট্টগ্রামে ঢাকার মতো কোনো হাইড্রেন্ট ছিল না। তবে গত মাসে চট্টগ্রাম ওয়াসার পক্ষ থেকে ৪১টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button