মশার শহর গাজীপুর, যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষ: নিধনে নেই কোনো উদ্যোগ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ২০ মার্চ সন্ধ্যা। এক আত্মীয়কে দেখতে এসেছেন গাজীপুরের টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে রাজধানী উত্তরার বাসিন্দা আবু ইউসুফ। ভেতরে চিকিৎসক রোগী দেখছেন। কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয় তাঁকে। আবু ইউসুফ হাসপাতাল চত্বরে শহীদ মিনারের বেদিতে বসেছেন। ঠিক ২০-২৫ সেকেন্ডের মধ্যে মশা ছেঁকে ধরেছে তাঁকে। অতিষ্ঠ হয়ে তিন–চারবার জায়গা পরিবর্তন করলেন। কিন্তু রক্ষা পেলেন না। বাধ্য হয়ে তাঁকে পালাতে হয়েছে।

ঠিক একই ধরনের যন্ত্রণার কথা জানালেন টঙ্গীর গোপালপুর এলাকার বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদাউস। মশার যন্ত্রণায় রাতের বেশির ভাগ সময় না ঘুমিয়ে কাটান বলে জানান তিনি। জান্নাতুল বলেন, মশার কামড় সহ্য করা যায় না। তাই মশা মারার জন্য রাতে বারবার ঘুম থেকে উঠতে হয়।

৩০ মার্চ ২০১৯ প্রথম আলো- পত্রিকায় প্রকাশিত ‘গাজীপুরে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ সকল তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এই চিত্র নিত্যদিনের। জলাশয়, রাস্তার পাশের নালা ও যত্রতত্র পড়ে থাকা ময়লা পরিষ্কার না করায় বেড়েছে মশার উপদ্রব। মশক নিধনে সিটি করপোরেশন নিচ্ছে না কোনো উদ্যোগ। মশার ওষুধও ছিটানো হচ্ছে না। এলাকাবাসী বিষয়টি স্থানীয় কাউন্সিলরদের জানানোর পরও কাজ হচ্ছে না।

১৪ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত টঙ্গী বাজার, আরিচপুর, বউবাজার, টঙ্গীর আনারকলি রোড, দত্তপাড়া, ফাইসন্স সড়ক, মিরাসপাড়া, এরশাদনগর, কলেজ গেট, আউচপাড়া, মাজার বস্তি, বোর্ডবাজার, বড়বাড়ি, খাইলকৈর বটতলা, যোগীতলা বাজার, ঝাঁজর, জয়দেবপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ রোড, জোড়পুকুর বটতলা, রাজবাড়ি মাঠের আশপাশসহ প্রায় ২৫টি এলাকা ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোথাও গত এক বছরে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেননি তাঁরা। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে রাখেন, নয়তো বন্ধ করে রাখেন ঘরের দরজা–জানালা।

টঙ্গী বাজার এলাকার বাসিন্দা লুৎফুন্নেসা বেগম বলেন, ‘মশার যন্ত্রণায় ঠিকমতো নামাজও পড়া যায় না। সারাক্ষণ কানের কাছে ভনভন করতে থাকে। তা ছাড়া, ঘরে বাচ্চা থাকায় কয়েলও জ্বালাতে পারি না।’

জয়দেবপুর শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদ রোডের বাসিন্দা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের কোনো সুবিধাই পাচ্ছি না। ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটালে এ সমস্যা হতো না।’

এদিকে সন্ধ্যার পর গাজীপুর সিটির হাসপাতালগুলোতে মশা ছেঁকে ধরে। ১৫ মার্চ বিকেলে টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের ভেতর গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে বসে আছেন ষাটোর্ধ্ব এক রোগী। শয্যার নিচে জ্বলছে কয়েল।

সদ্য ভর্তি হওয়া হনুফা বেগম নামের এই রোগী বলেন, ‘হাসপাতালে আইছি সুস্থ হইতে। কিন্তু মশার যন্ত্রণায় মনে হচ্ছে আরও অসুস্থ হইয়া যামু।’ একই অবস্থা দেখা গেছে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেলের সামনে। এখানে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে মশার ছড়াছড়ি। এর মধ্যেই মশার কামড় সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক রোগী।

এ বিষয়ে কথা হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১০ জন কাউন্সিলরের সঙ্গে। এর মধ্যে সব কাউন্সিলর মশক নিধনের দায় চাপিয়েছেন সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের ওপর।

তাঁরা বলছেন, এ বিষয়ে জানানো হলে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বাজেট নেই বলে এড়িয়ে যায়। এভাবে একাধিকবার জানানো হলেও তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা প্রতিটা মিটিংয়ে এ বিষয়টি উপস্থাপন করি। কিন্তু আমাদের কথায় কোনো কর্ণপাত করা হয় না।’

৩৭, ৩৮, ৩৯ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শিরিন আক্তার বলেন, ‘জনগণ আমাদের সব সময় বলে। কিন্তু আমরা তাঁদের জন্য কিছুই করতে পারি না। এ পর্যন্ত মশক নিধনের কোনো উদ্যোগই সিটি করপোরেশন নেয়নি।’

আর ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহ আলম বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে বাজেট না দিলে নিজের পকেটের টাকায় আমাদের পক্ষে মশক নিধন সম্ভব না। আমি বহুবার বিষয়টি বলেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয় না।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য ২০১৭–১৮ অর্থবছরে সিটি করপোরেশনের ব্যয় দেখানো হয়েছে ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৬১৬ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ৩৯ হাজার ৭০ টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রাহাতুল ইসলাম বলেন, ‘কাউন্সিলররা তো বলবেনই। এত বড় সিটি করপোরেশন, হয়তো আশা অনুযায়ী দিতে পারছি না। তা ছাড়া আমাদের কাছে টুকটাক যে হাতিয়ার আছে, তা দিয়ে মশার ওষুধ দিচ্ছি। তবে ব্যাপকভাবে কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি।’

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘পুরো শহরে ওষুধ দিতে গেলে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা লাগবে। সেই অনুযায়ী আমাদের বাজেট নেই। তবু আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, স্কুল–কলেজ, হাসপাতাল এলাকায় আগে শুরু করতে চাই।’

 

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button