মুনাফালোভীদের চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বাংলাদেশে সাধারণ ক্রেতারা ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার লোভে পিষ্ট হচ্ছেন। ক্যাব বলছে, ব্যবসায়ীরা শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি লাভ করেন।
আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়েও শতভাগ বেশি মুনাফা করা হয় বলে দাবি সংগঠনটির।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, আমদানি করা পণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের দাম বেধে দেয়ার আইন আছে। তবে সাধারণভাবে সব পণ্যেই সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ পর্যন্ত স্বাভাবিক মুনাফা করা হবে বলে ধরে নেয়া হয়। এর বেশি হলে সেটা অস্বাভাবিক।
অতিমুনাফার চিত্র
এবার ভোজ্য তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সময়ে মৌসুমি ফল তরমুজ নিয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা খুলনায় তরমুজের ভালো ফলন হয়। জানা গেছে, সেখানকার ক্ষেত থেকে ১০০ তরমুজ গড়ে আকারভেদে ১২ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
এই হিসেবে গড়ে প্রতিটি তরমুজের দাম পড়ে ১২০ থেকে ২০০ টাকা। কিুন্ত সেই তরমুজ রাজধানী ঢাকায় বিক্রি হয়েছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা করে।
তরমুজের বিক্রিতে অধিক লাভের উদ্দ্যেশে নানা কৌশল করা হয়েছে। পিস হিসেবে তরমুজ কিনে তা বিক্রি করা হয়েছে কেজি দরে। এই হিসেবে ঢাকায় এক কেজি তরমুজ ৩০ টাকার বেশি না হওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি করা হয়েছে ৬০ টাকা কেজি দরে।
এখন অবশ্য তরমুজ বিক্রেতাদের মাথায় হাত৷ কেননা মৌসুমি ফল আম ও লিচু বাজারে চলে আসায় তরমুজ বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়ে।
শাকসবজির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গত রমজানে বেগুনের দাম কেজি প্রতি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন কৃষক বেগুন বিক্রি করেছে চার-পাঁচ টাকা কেজি দরে৷ কাঁচা মরিচেরও একই অবস্থা।
এদিকে ঢাকা শহরের মধ্যেই সবজির দাম বজার ভেদে নানা রকম। বাজারের হিসেব অনুযায়ী, মিরপুরের শাহ আলী বাজার থেকে কারওয়ান বাজারে যেকেনো সবজির দাম গড়ে পাঁচ থেকে দশ টাকা বেশি হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের বেশি মুনফা করার লোভের কারণেই বাজারে এই অবস্থা তৈরি হয়। আর এই মুনাফা হাতিয়ে নেয় মধ্যসত্ত্বভোগীরা। লাভের অংশ কৃষকরা পান না।
বাংলাদেশে এই মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম সবচেয়ে বেশি বাড়ে রোজার মাসে৷ সরবরাহ ঠিক থাকার পরেও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফা লুটে। আর এরজন্য তারা কখনো সরবরাহ ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে আবার কখনো পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
তবে মুনাফালোভীরা শুধু রমজান মাস নয়, সবসময়ই অজুহাত খোঁজেন। যেমন ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের খবর এলেই বাজারে পেয়াঁজের দাম কেজি প্রতি দশ টাকা বেড়ে যায়। অথচ দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজের মজুত আছে।
দেশে গমের মজুতে এখনো ঘাটতি না পড়লেও বাজারে দাম বাড়ছে৷ চালেরও একই অবস্থা।
গত মার্চে সয়াবিন তেলের দাম প্রথম দফায় বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা লিটার করা হয়েছিল। কিন্তু বাজারের হিসেব করলে দেখা যায়, পরিস্থিতি এমন হওয়ার কথা ছিল না। কেননা মার্চ মাসে দেশের বাজারে যে তেল ছিলো তা ডিসম্বেরের আগে আমদানি করা।
গত ডিসেম্বরে বিশ্ব বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল এক হাজার ৪১১ ডলার। ট্যারিফ কমিশন থেকে জানা যায়, প্রতি টন আমদানিতে তখন জাহাজ ভাড়া পড়েছিল ৭০ ডলার৷। প্রতি টন সয়াবিন তেল চট্টগ্রাম বন্দরে আনতে খরচ পড়ে এক হাজার ৪৮১ ডলার। টাকার অংকে সেটি পড়ে এক লাখ ২৭ হাজার ৩৬৬ টাকা ( ওই সময়ে ১ ডলার = ৮৬ টাকা হিসেবে)। সে হিসেবে বন্দর পর্যন্ত প্রতি লিটারের দাম পড়েছে ১২৭ টাকা ৩৬ পয়সা।
বন্দরে পৌঁছানোর পর ভোক্তার হাত পর্যন্ত যেতে প্রতি লিটারে যোগ হয় আরো ২৫ থেকে ২৭ টাকা। এর মধ্যে আছে মিলে রিফাইনিং খরচ, সরকারি ভ্যাট, এআইটি, ইনসুরেন্স ব্যয় এবং ব্যবসায়ীদের লাভ।
এই হিসেবে ভোক্তা পর্যায়ে তখন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের মূল্য হওয়ার কথা ছিল ১৫২ থেকে ১৫৩ টাকা। কিন্ত বাজারে তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা।
শুধু খাদ্যপণ্যই নয়। মুনাফা করার অতি লোভ সব খাতেই চোখে পড়ে। গত ঈদে দেখা গেছে আগের দামের ট্যাগের ওপরেই দাম বাড়িয়ে নতুন ট্যাগ লাগিয়ে পোশাক বিক্রি করা হচ্ছে। এই অভিযোগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করে ভোক্তা অধিদপ্তর।
গড়ে ৪০ ভাগের বেশি অতিরিক্ত মুনাফা
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতিটি পণ্যেই স্বাভাবিক মুনাফার চেয়ে গড়ে ৪০ ভাগ বেশি মুনাফা করেন ব্যবসায়ীরা। আর কোনো অজুহাত পেলে তো কথাই নেই।’’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ঈদের সময় এক হাজার টাকার কাপড় দোকানদাররা বিক্রি করেছেন ১০ হাজার টাকায়। কৃষিপণ্যে সারা বছরই অতিমুনাফাচক্র কাজ করে। কৃষক দাম পায় না৷ কিন্তু ওই চক্রটি দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটে নেয়।’’
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনটির এই নেতা আরো বলেন, ‘‘সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে দাম বেড়েছে এখানকার ব্যসায়ীরা তার অনুপাতে বেশি দাম নিচ্ছেন। পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়ানো হলো। কিন্তু দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নাই।’’
তিনি জানান, ‘‘কাপড় ও পোশাকের ক্ষেত্রে ১০০ ভাগেরও বেশি অস্বাভাবিক মুনাফা করা হয়। কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ৪২ ভাগেরও বেশি। গড়ে সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে ৪০ ভাগেরও বেশি অতিরিক্ত মুনাফা করা হয়।’’
মুনাফালোভীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘‘তরল দুধের দাম বাড়ল কেন? এর সাথে আন্তর্জাতিক বাজারের কি কোনো সম্পর্ক আছে? ৬৫ টাকা লিটারের তরল দুধ এখন ৯০ টাকা। শুধুমাত্র অতিমুনাফার লোভে এটা হয়েছে।’’
তার কথা, ‘‘হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাঁচ টাকার পরোটা ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার পরোটার আকারও ছোট করা হয়েছে। কিন্তু পরোটা বানানোর পণ্যের দাম কি দুইগুণ বেড়েছে? এটা হলো একটা মানসিকতা। আমাদের সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাই সবসময় অতি মুনাফার জন্য মুখিয়ে থাকে।’’
বাজার দেখবে কে?
বাজার অস্বাভাবিক হলে তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের। সম্প্রতি তারা কয়েকটি ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে।
কমিশনের সদস্য ড. এ এফ এম মনজুর কাদির বলেন, ‘‘কেউ বাজার প্রভাবিত করছে কি না অথবা বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হচেছ কি না সেটা আমরা দেখি। কিন্তু সাধারণভাবে বাজারমূল্য দেখা আমাদের কাজ নয়।”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমদানি করা কিছু পণ্যের দাম সরকার বেধে দেয়। সেটা আমরা দেখতে পারি। তবে কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে তথ্য নিয়ে অন্যান্য পণ্যও আমারা দেখতে পারি। তবে সেটা আমরা এখনো শুরু করিনি।’’
কয়েক সপ্তাহ আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আলি আহাদ খান জানান, ‘‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি এরকম ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু জামা, জুতো এগুলো আপনাকে দেখেই কিনতে হবে। তবে কেউ যদি অস্বাভাবিক দাম নেয় সেটা দেখার দায়িত্ব ভোক্তা অধিদপ্তরের।’’
তিনি বলেন, ‘‘কোনো আইন নাই তবে আমরা শতকরা ২০-৩০ ভাগ লাভকে স্বাভাবিক লাভ হিসেবে বিবেচনা করি। এর বেশি হলে সেটা অতিরিক্ত।”
আমদানি করা এই ধরনের পণ্যের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে কি না তা ধরা সহজ। তবে দেশীয় পণ্যের অতিরিক্ত দামও একটু অনুসন্ধান করলেই চিহ্নিত করা যায় বলে মনে করেন তিনি।
তবে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে রয়েছে ট্যারিফ কমিশন এবং ভোক্তা অধিদপ্তর। কিন্তু তারপরও অতি মুনাফালোভীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
সূত্র: ডয়চে ভেলে