মাদক সরবরাহ বন্ধ না করেই ডোপ টেস্ট?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গাড়ি চালকদের পর এবার সরকারি চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ডোপ টেস্টের চিন্তা করছে সরকার। কিন্তু মাদকের সরবরাহ বন্ধ না করে এই ধরনের ডোপ টেস্ট কতটা ফল দেবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক নির্মূলে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার একটি ডোপ টেস্ট। শুধু ডোপ টেস্ট দিয়ে কোন ফল মিলবে না। সরকারের সবগুলো সংস্থাকে একসঙ্গে মাদক নির্মূলে কাজ করতে হবে।
রোববার ছিল আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে দিবসটি। প্রতি বছরই ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘মাদক সেবন রোধ করি, সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ি।’
দিবসটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে দেশেও। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মাদক সেবন, ব্যবসা ও পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশ অন্যতম। মাদকের ভয়াল গ্রাস দেশে ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘‘সব ধরনের মাদকের বিষয়ে আমাদের সতর্কতা রয়েছে।
পাশাপাশি নতুন নতুন মাদক নিয়েও আমরা গবেষণা করছি। যখন যে মাদকটি সামনে আসছে সেটার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
মাদক বিরোধী দিবসের এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সরকারি চাকরিতে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করে শিগগিরই আইন হচ্ছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রেও ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করে আইন সংশোধন করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী দাবি করেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শুধু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ নয়, যুব সমাজকে মাদকদ্রব্যের ছোবল থেকে রক্ষার কাজও করছে বাহিনীগুলো।
প্রতিবেশী দেশ থেকেমাদকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতেও কাজ করছে সরকার। ভয়ঙ্কর ইয়াবা ও আইস মিয়ানমার থেকে আসছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সে দেশকে (মিয়ানমার) অনুরোধ করেছি, তারা কথা রাখেন না। ইয়াবা সাপ্লাই বন্ধ করতে বলেও কাজ হয়নি। তবে ভারত সরকার ইতোমধ্যে সীমান্তঘেঁষা ফেনসিডিল কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।”
রোহিঙ্গাদের অনেকেই মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ তিনি বলেন, তারা মিয়ানমার থেকে এ দেশে মাদক নিয়ে আসে। মিয়ানমার সীমান্তে ইতোমধ্যে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মাদকের সঙ্গে যারাই জড়িত, প্রশাসন বা রাজনীতিক সবাইকে আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
বর্তমানে গাড়ি চালকদের ক্ষেত্রে লাইসেন্স পেতে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ নিয়েও চালকদের ভোগান্তির শেষ নেই। আইন করে বাধ্যতামূলক করলেও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও আরেকটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও টেস্ট হচ্ছে না। ফলে এই দু’টি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার জন্য চালকদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সবগুলো হাসপাতালে গাড়ি চালকদের ডোপ টেস্টের নির্দেশনা দেওয়া হলেও এখনও চালু হয়নি। আর মাদক নির্মূলে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার একটি ডোপ টেস্ট। শুধু ডোপ টেস্ট দিয়ে হবে না৷ সবকিছু মিলিয়ে চেষ্টা করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।”
জানা গেছে, গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ইয়াবা, গাঁজা ও ফেনসিডিলসহ মাদক সংশ্লিষ্ট ২০ হাজারেরও বেশি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে সব সংস্থা মিলে ইয়াবা জব্দ করেছে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার৷ ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ৮ হাজার বোতল। কোকেন জব্দ করা হয় প্রায় ৪ কেজি, হেরোইন ২১০ কেজি৷ ২০২১ সালে মাদক-সংক্রান্ত ৪৭ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। এই হার ২০২০ সালে ছিল ৪৩ শতাংশ।
এদিকে, ফেনসিডিল ও ইয়াবার পর নেশা হিসেবে এখন ক্রিস্টাল মেথ বা আইস ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠছে। প্রায়ই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জব্দ হচ্ছে আইস। দেশে যেসব রুট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে, তার প্রায় সব ক’টি দিয়ে আইসও আসছে। দেশের যে কোনো প্রান্তে হাত বাড়ালেই এখনও মিলছে ইয়াবা ও ফেনসিডিল। একইভাবে আইসও ছড়িয়ে পড়ছে৷ এদেশে তুলনামূলক নতুন এই মাদক ঠেকানোকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘‘এতদিন আইস আসত বিমানে৷ ফলে দেশে আইসের প্রভাব কম ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একটা চালান ধরার পর জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকেও আইস আসছে। ফলে এখন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এটা ছড়িয়ে পড়ার। আমরা সব ধরনের মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছি।”
গত বছর মাদক বহনের দায়ে ১৩ হাজার ৯০৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৫ হাজার ২০৬ জনকে গ্রেপ্তার করে সাজা দেওয়া হয়। ২০২০ সালে ২৩ হাজার ১৯৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দণ্ড দেওয়া হয় ১০ হাজার ৪৯৮ জনকে। এ ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও টেকনাফের জন্য গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। এর আওতায় সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও আইসের ক্ষতিকর দিক উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, এটি শক্তিশালী আসক্তি সৃষ্টিকারী মাদক। এতে আসক্ত ব্যক্তির ক্ষুধামান্দ্য ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়৷ অতিরিক্ত উত্তেজনা তৈরি করে উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে অনেকে সহিংস আচরণও করেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদক নিয়ন্ত্রণে আন্তঃবাহিনী ও সংস্থার সমন্বয় নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। মাদকের চাহিদা, সরবরাহ ও ক্ষতি হ্রাস এবং নানামুখী কাজে ১১টি মন্ত্রণালয় জড়িত।
২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করেছিল র্যাব। এরপর পৃথকভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালায় পুলিশ, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে। অনেকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’-কে মাদক নির্মূলে শেষ ভরসা মনে করলেও এটা খুব ফলপ্রসূ হয়নি।
সূত্র: ডয়চে ভেলে