পিটিয়ে আলোচিত শাসক দলের এমপিরা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বাংলাদেশে আইন প্রণয়নকারী এমপিদের একাংশ এখন পেটানো নিয়ে আলোচনায়। শিক্ষক, দলীয় নেতা-কর্মী কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। তারা রীতিমত ‘পাড়ার মাস্তান’ বলছেন কেউ কেউ। এমপিদের কেন এই নেতিবাচক আত্মপ্রকাশ?

সর্বশেষ আলোচনায় এসেছেন কুমিল্লা-৪ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরাজি মোহাম্মদ ফখরুল। তিনি দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালোম আজাদকে কিল ঘুসি মেরে রক্তাক্ত করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। খোদ সংসদ ভবনের ভেতরেই এই ঘটনা ঘটে। শনিবার বিকেলে জাতীয় সংসদের এলডি হলে দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির বৈঠকে তৃণমূলে কমিটি গঠন এই কিল ঘুসির ঘটনা ঘটে। উপজেলা চেয়ারম্যানও কিল-ঘুসির পাল্টা জবাব দিয়েছেন বলে জানা যায়।

গত ৭ জুলাই রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে তার ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেকে নিয়ে মারপিট করেন রাজশাহী-১ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। ওই অধ্যক্ষকে তিনি ১৫ মিনিট ধরে কিল ঘুসি ছাড়াও হকি স্টিক দিয়ে পেটান। অধ্যক্ষের অপরাধ তিনি সংসদ সদস্যের কথা মত একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত ছাড়া তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে রাজি হননি।

এভাবে মারপিট করে সরকার দলীয় আরো যেসব সংসদ সদস্য আলোচনায় আছেন তারা হলেন শওকত হাচানুর রহমান রিমন, আনোয়ারুল আজীম, কাজী মনিরুল ইসলাম মনু,আবদুর রহমান বদি প্রমুখ।

গত ১৯ মে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজে ঢুকে দুই সহকারী অধ্যাপককে মারধর করেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। সংসদ সদস্যের এক প্রিয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার কাগজপত্র চেয়ে না পেয়ে তিনি এই কাজ করেন বলে অভিযোগ।

বরগুণা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমনের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর পাথরঘাটা এলাকায় এক সভামঞ্চে উঠিয়ে নজরুল ইসলাম নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকেমারধর করেন। নজরুল ইসলামের মাইক্রোবাস সংসদ সদস্যের গাড়ি বহরকে রাস্তায় জায়গা ছাড়তে দিতে করায় তিনি এভাবে প্রকাশ্যে শাস্তির ব্যবস্থা করেন। গত ২১ মে ফোরকান নামে এক চায়ের দোকানদারকেও মারধোর করেন তিনি।

ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর দলিল লেখক আনোয়ার হোসেনকে তার অফিসে দলবল নিয়ে গিয়ে মারধর করেন৷

কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি সংসদ সদস্য থাকার সময়েও এমন করেছেন। গত ২২ এপ্রিল তিনি টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তার দলবল নিয়ে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের মারধর করেন। তার পছন্দমতো কমিটি না হওয়ায় তিনিওই হামলা চালান। এরা সবাই শাসক দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। মারপিটের ঘটনার পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো পুলিশি বা দলীয় ব্যবস্থা নেয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরসেদ বলেন, ‘‘ সংসদ সদস্যদের কাজ সংবিধানে স্পষ্ট করা আছে। তাদের কাজ দেশের আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু এখন দেখছি তারা মারপিট করছেন। আসলে যেমন সংসদ সদস্য তেমন তারা আচরণ করছেন। দল থেকেও তাদেরই চাওয়া হয়েছে৷ নয়তো তারা মনোনয়ন পেয়েছেন কীভাবে! তিনি মনে করেন, তাদের আচরণ দেখেই এই সংসদের কী ভাবমূর্তি আছে তা বোঝা যায়। কেউ সংসদের ভাবমূর্তি নিয়ে ভাবলে তারা সংসদ সদস্য হতে পারতেন না। আর দলও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত। কিন্তু ব্যবস্থা তো নেয়না৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সাহস পায়না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, ‘‘সংসদ সদস্যরা এখন বেসামাল হয়ে উঠেছেন। তারা সব জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করতে চান৷আর যেখানেই তারা বাধা পান সেখানেই তারা আগ্রাসী হয়ে উঠছেন। এমনকি তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দখল করতে চাইছেন। সেখানে তাদের মধু আছে। তাই তারা শিক্ষকদেরও ছাড়ছেন না। তার কথায়, ‘‘এটা দল এবং সরকারের দেখা উচিত৷ তা না হলে তো শৃঙ্খলা থাকবে না।

তবে আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘‘যে সব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তা অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে। যদি অভিযোগ প্রমাণ হয় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারা কিন্তু দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নাই। তারা যা করছেন তা আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শবিরোধী। তাদের কাজ নিন্দনীয়৷ শেখ হাসিনা তাদের ক্ষমা করবেন না। এমনও হতে পারে আগামী নির্বাচনে তারা আর মনোনয়ন পাবেন না।”

এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা তো দেখা যাচ্ছেনা-এই কথার জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেয়া হয়, তাই সময় লাগে। এর আগে তখনকার সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

এদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদ সদস্যেদের হাতে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের মার খাওয়ার ঘটনার বিচারের ভার জাতীয় সংসদের স্পিকারের হাতে দিয়েছেন। তিনি রোববার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো উত্থাপন হওয়ায় খুব বিব্রতকর। আর সেগুলো যদি সত্য হয়, সত্য প্রমাণিত হয় সেগুলো আরো বিব্রতকর। তবে যদি কোনো সংসদ সদস্য এ ধরনের কাজে যুক্ত থাকেন সেক্ষেত্রে সেই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আমরা মন্ত্রণালয় হিসেবে সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। যেটি আমরা করতে পারি, তা হল, আমরা স্পিকারের শরণাপন্ন হতে পারি এবং তার মাধ্যমে তার কাছে অভিযোগ উত্থাপন করে আমরা এটির একটি সমাধান চাইতে পারি।”

এ বিষয়ে চেষ্টা করেও জাতীয় সংসদের স্পিকারে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button