কালীগঞ্জে প্রসূতির মৃত্যু: সেই মাসুদসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা, জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ

নিজস্ব সংবাদদাতা : কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষের অবহেলায় শিরিনা আক্তার (৩০) নামে এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় আলোচিত চিকিৎসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাসুদসহ ৯ জনের নামে মামলা দায়ের হয়েছে। এছাড়াও গ্রেপ্তার ৬ আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
বৃহস্পতিবার (২৫ আগষ্ট) দুপুরে গ্রেপ্তার ৬ আসামিকে আদালতে পাঠিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। রিমান্ড শুনানি শেষে আদালত এ আদেশ দেন।
এর আগে বুধবার (২৪ আগষ্ট) র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) অভিযুক্ত ৬ জনকে আটক করে কালীগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করে। পরে অন-অনুমতি ব্যক্তির মাধ্যমে রক্ত পরিচালনা করে রক্তগ্রহীতার মারাত্মক ক্ষতি করে একে-অপরের পরস্পর যোগসাজশে একই উদ্দেশ্যে অবেহেলার কারণে মৃত্যু ঘটানোর অপরাধে ৩০৪ (ক) এবং ১০১/৩৪ ধারায় এবং ‘নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন আইন’ এর ২৫ ধারায় মধ্যরাতে মামলা নথিভুক্ত করা হয় {মামলা নাম্বার ১৮(৯)২২}।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কালীগঞ্জ থানার কর্তব্যরত ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) সাব্বির হায়দার শুভ।
মামলার বাদী নিহত প্রসূতির স্বামী দক্ষিণ চুয়ারিয়াখোলা এলাকার মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক মিয়া (৩৯)।
অভিযুক্ত গ্রেপ্তার আসামিরা হলো টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার থানার আগদেউলি এলাকার চাঁন মিয়ার ছেলে ওটি বয় আশিকুর রহমান (২৫), কালীগঞ্জের পিপ্রাশৈর এলাকার অরুন কস্তার মেয়ে সিনিয়র নার্স সংগিতা তেরেজা করা (৩৩), তুমুলিয়া এলাকার ক্লেমেন্ট ক্রুশের স্ত্রী জুনিয়র নার্স মেরী গমেজ (৪০), তুমুলিয়া এলাকার সিরাজুল ইসলামের মেয়ে হাসপাতালের অন্যতম অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্যা আক্তার (৩১), ঢাকার লালবাগ এলাকার ধানেছ আলীর মেয়ে রিসেপশনিস্ট শামীমা আক্তার (৩২), বালীগাঁও এলাকার শরিফ মিয়ার স্ত্রী নার্স সীমা আক্তার (৩৪)। তাদের সকলকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সদস্যরা।
এছাড়াও পলাতক আরো তিনজনকে এবং অজ্ঞাত আরো ৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পলাতক আসামিরা হলো বালীগাঁও এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম (৩১), টাঙ্গাইল সদরের পাড়দিঘুলীয়া এলাকার হাফিজ উদ্দিনের ছেলে ডাঃ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আলমাসুদ (৫০) এবং মাগুরা জেলার মহাম্মদপুর থানার নজির মিয়ার ছেলে প্যাথলজিস্ট শাওন (২৪)।
হাসপাতাল থেকে শিরিন বেগমকে দেয়া ছাড়পত্রে চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সার্জন নূপুর এবং অ্যানেস্থেসিয়া মাসুদ। কিন্তু সিজারিয়ানের সময় মাসুদ থাকলেও নূপুর নামে কোন চিকিৎসক ছিলেন না।
জানা গেছে, কোন অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক দিয়ে অপারেশন করার নিয়ম নেই। অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসকের কাজ হচ্ছে রোগীকে অপারেশনের পূর্বে অজ্ঞান করা। কিন্তু কোন সার্জন চিকিৎসক ছাড়াই কালীগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক দিয়েই প্রতিনিয়ত চলছে সিজারিয়ান অপারেশন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানায়, অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক মাসুদ নরসিংদীতে একটি হাসপাতালে চাকরি করেন। এছাড়াও কালীগঞ্জের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে তিনি নিয়মিত অপারেশন করে থাকেন। নূপুর হলো তার স্ত্রী। তিনি নরসিংদী সরকারি হাসপাতালের সার্জারি চিকিৎসক। পুরো নাম শামীমা জাহান নূপুর। মাসুদ যে সকল সিজারিয়ান করে সেসব নথিপত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে সার্জন চিকিৎসক হিসেবে নূপুর নাম ব্যবহার করে থাকে।
জানা গেছে, এর আগে ২০২০ সালের ১০ এপ্রিল কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভূল চিকিৎসায় বেতুয়া এলাকার মিশু বেগম নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছিল। সে সময় এক লাখ টাকায় ওই ঘটনা সমোঝতা করেছিল। এরপূর্বে একই হাসপাতালে ভূল চিকিৎসায় ভাদগাতী এলাকার এক নবজাতক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
বুধবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানায়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) রাতে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১ এর পূর্বাচল ক্যাম্পের একটি দল। এর আগে গত ২১ আগস্ট সকালে কালীগঞ্জের দক্ষিণ চুয়াড়িয়াখোলা এলাকার বাসিন্দা শিরিন বেগমের প্রসব বেদনা উঠলে পূর্ব পরিচিত জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্যা আক্তারের মাধ্যমে ওই হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ভর্তি হয়। পরে ওটি বয় আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা ও আল্টাসনোগ্রাম করে সিজারের জন্য রোগীকে ওটিতে নেওয়া হয়। চিকিৎসক মাসুদ গাইনোকোলোজিস্ট না হয়েও রোগীর সিজার করেন। অপারেশন শেষে ব্লিডিং হওয়ায় চিকিৎসক মাসুদের পরামর্শে আশিক ও বন্যা রোগীর পরিবারকে ‘এবি’ পজিটিভ রক্ত সংগ্রহের কথা বলেন। ভিকটিমের ভাই ও ননদের ছেলের ‘এবি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত হওয়ায় তাদের কাছে রক্ত সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়। প্রথমে ভিকটিমের ভাইয়ের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে রোগীর শরীরে পুশ করা হয়। আরও এক ব্যাগ রক্ত নিতে ননদের ছেলেকে বেডে শোয়ানো হয়। এরমধ্যেই হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সরা ভিকটিমের শরীরে ‘বি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত পুশ করেন। ভিকটিমের ‘এবি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্তের পরিবর্তে ‘বি’ পজিটিভ রক্ত পুশ করায় রোগীর খিঁচুনি ওঠে। এ সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর চিকিৎসা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সন্ধ্যার দিকে তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ভিকটিমের পরিবার রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আসার পথে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সে সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মিত কোন ডাক্তার ছিলো না। মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালটি। হাসপাতালটিতে গড়ে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০টি সিজারিয়ান অপারেশনসহ প্রায় ৫০টির অধিক বিভিন্ন অপারেশন সম্পন্ন করা হতো বলে গ্রেপ্তার আসামিরা জানায়। এক্ষেত্রে হাসপাতালে কোন রোগী আসলে অন কলে থাকা বিভিন্ন ডাক্তারদেরকে ডাকতেন। সিজারিয়ান অপারেশনের ক্ষেত্রে একজন গাইনোকোলজিষ্টের ওটি চার্জ ছিলো তিন হাজার টাকা এবং অ্যানেস্থেসিয়ার দেড় হাজার টাকা। সর্বমোট সাড়ে চার হাজার টাকা ডাক্তারদের দিত হাসপাতাল কৃর্তৃপক্ষ। আর রোগী ভেদে বিভিন্ন প্যাকেজে ১০-১৫ হাজার টাকা নেয়া হতো। হাসপাতালে কর্মরত সকল নার্স এবং স্টাফদের প্রতিমাসে গড় মোট বেতন ছিলো এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও হাসপাতালটিতে অন্যান্য কিছু টেস্ট করা হতো যেমন-আল্ট্রাসনোগ্রাম, রক্তের (সিবিসি) টেস্ট ইত্যাদি।

গ্রেপ্তার বন্যা আক্তার ডিগ্রি পাস। তিনি হাসপাতালের অন্যতম অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার কোন নার্সিং ডিগ্রী নেই। তবে সে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ৭ বছর নার্সিং ও ২.৫ বছর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছিল। পরবর্তীতে সে ২০১৮ সালে ০৮ জনের যৌথ মালিকানায় “জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার” চালু করে।
গ্রেপ্তার আশিকুর রহমান এসএসসি পাস করে ২০১৬ সালে টাঙ্গাইল ম্যাটস থেকে ৩ বছরের ডিএমএফ (ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি) কোর্স পাস করে। পরিচয়ের সূত্রে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ হাজার টাকা মাসিক বেতনে জনসেবা হাসপাতালে ওটি বয় ও ডক্টরের সহকারী হিসেবে চাকরি করে। ঘটনার দিন আশিক ডাঃ মাসুদের সহকারী হিসেবে ওটিতে উপস্থিত ছিল। ওটির পূর্বে সে রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাম করে। রোগীর ভর্তি ও ডিসচার্জ পেপারে নিজেই স্বাক্ষর করে। তবে সেখানের নার্স ও ভিকটিম পরিবার তাকে ডাক্তার হিসেবে জানত। রোগী তদারকি, ডাক্তারদের সাথে সার্বক্ষণিক সমন্বয় রাখা, বিভিন্ন ধরণের টেস্ট করা ও ডাক্তারদের পক্ষে কাগজপত্রে ভুয়া স্বাক্ষর করার সাথে জড়িত ছিল সে।
গ্রেপ্তার সংগিতা তেরেজা কস্তা এসএসসি পাশ করে ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে একজন সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত। সে ৩ বছর মেয়াদী জুনিয়র নার্সিং কোর্স পাশ করে পনের হাজার টাকা বেতনে ৭ মাস ধরে চাকরি করেছে।
গ্রেপ্তার মেরী গমেজ এসএসসি পাশ করে একজন জুনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলো। সে ২ বছর মেয়াদী জুনিয়র নার্সিং কোর্স পাস করে সাত হাজার টাকা বেতনে ২ বছর ধরে চাকরি করছে।
গ্রেপ্তার সীমা আক্তার ওএসএসসি পাশ করে ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে নার্স হিসেবে কর্মরত ছিল। তার কোন নাসিং কোর্স বা ডিপ্লোমা ডিগ্রী নেই। সে ছয় টাকা বেতনে ৪ বছর ধরে চাকরি করছে।
এছাড়াও গ্রেপ্তার শামীমা আক্তার এসএসসি পাশ করে রিসেপশনিস্ট এবং রোগী দেখার সিরিয়াল দেয়ার কাজ করতেন। তার কোন নার্স কোর্স বা ডিপ্লোমা নেই। সে সাত হাজার পাঁচশত টাকা বেতনে ২ সপ্তাহ ধরে চাকরি করছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান খান বলেন, প্রসূতি মৃত্যুর আলোচিত ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার ৬ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে বৃহস্পতিবার (২৫ আগষ্ট) আদালতে আবেদন করা হয়। রিমান্ড শুনানি শেষে গাজীপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২-এর বিচারক রাগীব নূর আসামিদেরকে ২ দিন জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদেশ দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, আদালতের নির্দেশে গ্রেপ্তার ৬ আসামিকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
আরো জানতে……..
কালীগঞ্জে প্রসূতির মৃত্যু: হাসপাতালের পরিচালক বন্যাসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব
কালীগঞ্জে ‘অ্যানেস্থেসিয়া’ চিকিৎসক দিয়ে সিজারিয়ান, প্রসূতির মৃত্যু: ৬ জন গ্রেপ্তার
কালীগঞ্জে ‘অ্যানেস্থেসিয়া’ চিকিৎসক দিয়ে সিজারিয়ান, প্রসূতির মৃত্যু: ছাড়পত্রে জালিয়াতি!