ক্রমান্বয়ে ভারতের বৃহৎ রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে সম্প্রতি তার কার্যালয়ে দেখা করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। সেখানে ভারতের পক্ষ থেকে ঢাকা থেকে দর্শনা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত আরেকটি ট্রেন চালু করার প্রস্তাব দেন ভারতীয় হাইকমিশনার। বাংলাদেশ প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছে।

প্রায় ৫৩ বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালের এপ্রিলে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস চালুর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্ন রেল সংযোগ চালু করে বাংলাদেশ ও ভারত। এরপর এ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে খুলনা-কলকাতা (মিতালী এক্সপ্রেস) ও ঢাকা-জলপাইগুড়ি (বন্ধন এক্সপ্রেস) রুটে চালু হয়েছে যাত্রীবাহী আরো দুটি ট্রেন। ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকা-দর্শনা-কলকাতা রুটে আরেকটি ট্রেন চালু হলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চলাচলকারী যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যা দাঁড়াবে চারটিতে।

দ্বিপক্ষীয় কানেক্টিভিটি শক্তিশালী করতে সড়কের পাশাপাশি এখন রেলপথেও জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারত। এজন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের ভিত্তিতে আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগ শক্তিশালী করার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনের সংখ্যা আরো বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন দুই দেশের রেল খাতের নীতিনির্ধারকরা। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারতের বৃহদায়তনের রেল নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতাও এখন দিনে দিনে বাড়ছে।

বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল চলাচল চালু ছিল আটটি রুটে। এর মধ্যে পাঁচটি এখন দুই দেশের মধ্যকার রেল নেটওয়ার্ককে সচল রেখেছে। এগুলো হলো বেনাপোল (বাংলাদেশ)-পেট্রাপোল (ভারত), দর্শনা (বাংলাদেশ)-গেদে (ভারত), রোহনপুর (বাংলাদেশ)-সিংহাবাদ (ভারত), বিরল (বাংলাদেশ)-রাধিকাপুর (ভারত)। এর মধ্যে ঢাকা থেকে কলকাতাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস চলাচল করছে দর্শনা-গেদে রুট দিয়ে। খুলনা থেকে কলকাতা অভিমুখী বন্ধন এক্সপ্রেস যাতায়াত করছে বেনাপোল-পেট্রাপোল দিয়ে। চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুট দিয়ে ঢাকা থেকে জলপাইগুড়িতে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে মিতালী এক্সপ্রেস। রুটগুলো দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন তিনটির পাশাপাশি পণ্য পরিবহনও করা হচ্ছে। সচল বাকি দুটি রুট ব্যবহার হচ্ছে শুধু পণ্য পরিবহনের কাজে। বন্ধ থাকা তিনটি রুটও ক্রমান্বয়ে চালু করা হবে বলে গতকালই জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী। এর মধ্যে আখাউড়া থেকে ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ এখন চলমান রয়েছে। শিগগিরই এ কাজ শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

পূর্ব বাংলায় রেল চলাচলের সূচনা ১৮৬২ সালে। বাণিজ্যিক প্রয়োজন ও শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার তাগিদে পূর্ব বাংলাসহ গোটা উপমহাদেশকেই রেল নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশরা। দেশভাগের পরও দীর্ঘকাল এ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিল পূর্ব বাংলা। এতে ছেদ পড়ে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়। স্বাধীনতার পর এ নিয়ে নানা সময়ে আলোচনা হলেও ২০০৮ সালের আগে তা পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়নি।

পুরনো এ রেল নেটওয়ার্ককে সচল করার পাশাপাশি দুই দেশের বিদ্যমান রেলপথগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার কাজও এখন চলমান রয়েছে। পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত একটি মিটার গেজ রেললাইনকে ডুয়াল গেজে রূপান্তর এবং খুলনা-দর্শনা সেকশনে নতুন ডুয়াল গেজ রেলপথ নির্মাণের দুটি প্রকল্পের পরামর্শক সেবার জন্য গতকালই একটি চুক্তি সই হয়েছে। দুটি প্রকল্পই ভারতীয় অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, পার্বতীপুর-কাউনিয়া ডুয়াল গেজ নির্মিত হলে ভবিষ্যতে আমরা ভারত ছাড়াও নেপাল, ভুটানের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়াতে সক্ষম হব এবং এর ফলে আমাদের যাত্রীসহ মালামাল পরিবহনের সুযোগ বাড়বে। আমাদের দেশের রেল ব্যবস্থা ব্রড গেজ ও মিটার গেজ দিয়ে দুই অঞ্চলে বিভক্ত। আমরা পর্যায়ক্রমে সব রেল ব্যবস্থাকে ব্রড গেজে রূপান্তর করছি। ভারতের সব রেললাইন ব্রড গেজে। আমরাও দেশের রেল ব্যবস্থাকে এক রকম ব্রড গেজে রূপান্তর করছি। এছাড়া রেললাইন সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে যে প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, সবগুলোকেই আমরা ব্রড গেজ আকারে করছি।

তিনি আরো বলেন, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে যে আটটি ইন্টারসেকশন বন্ধ হয়েছিল, এরই মধ্যে তার পাঁচটি চালু হয়েছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে চালু হবে। ভারত-বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক উত্তরোত্তর বাড়ছে।

দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্ক নিয়ে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এটিকে আরো কার্যকর ও সক্রিয় করে তোলা গেলে তা আঞ্চলিক বাণিজ্য ও কানেক্টিভিটি খাতকে আরো জোরদার করে তুলবে। বিশেষ করে বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল) এবং বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো জোরদার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক এসব জোটভুক্ত বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিবেশী অন্যান্য দেশও পরবর্তী সময়ে এ নেটওয়ার্কে যোগদানের মাধ্যমে লাভবান হতে পারে।

বাংলাদেশ এরই মধ্যে ভুটানের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে পণ্য পরিবহনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে চালু হওয়ার পর ঢাকার এ আগ্রহ বাস্তবায়নেরও বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ রুটটি ঢাকা-জলপাইগুড়ির মধ্যে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা রেল সংযোগ চালু করার পাশাপাশি উপআঞ্চলিক কানেক্টিভিটিতেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

রেলপথগুলো নিয়ে দিল্লিভিত্তিক ওআরএফ ফাউন্ডেশনের এক সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এ নেটওয়ার্ক পুনরুজ্জীবিত হলে তা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোর মধ্যে রেল যোগাযোগের সময় কমিয়ে আনবে অন্তত ৪ ঘণ্টা। একই সঙ্গে এ রেল নেটওয়ার্ক উপআঞ্চলিক পর্যায়ে কানেক্টিভিটিকে শক্তিশালী করার আরো সুযোগ তৈরি করে দেবে, যা ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ (আগে প্রতিবেশী) ও অ্যাক্ট ইস্ট (পুবে চলো) পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।

তবে এ ধরনের কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে উভয় দেশেরই লাভবান হওয়াটা জরুরি বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে শুধু একটি দেশের লাভবান হলে চলবে না। কানেক্টিভিটিকে সামনে রেখে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগে যেসব অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে, সেটিকে আসলে এখনো বড় পরিসরে দেখার মতো কিছু বলা চলে না। কানেক্টিভিটির কথা চিন্তা করলে বাংলাদেশ-ভারত অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরো বড় পরিসরে চিন্তা করা দরকার। এক্ষেত্রে রেলওয়ের অবকাঠামো বাড়াতে হবে। ভারতের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য ছোটখাটো রুট ঠিক করে বড় কিছু হবে না। আমি যদি ধরে নিই, একটা রেলওয়ে সংযোগে দিনে পাঁচটা বগি যায়, এখন সে জায়গায় ১০টা বগি নিয়ে যেতে হবে, তাহলে তো সেই রেলওয়ের অবকাঠামো বাড়াতে হবে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান যে অবকাঠামো রয়েছে, সেখানে ভারতের বিনিয়োগ দেখছি। কিন্তু বিদ্যমান অবকাঠামোয় বিনিয়োগ হলে সেটি তো কানেক্টিভিটি হলো না। আখাউড়া থেকে ভারতের আগরতলা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু ঢাকা থেকে দিল্লি, কেন হাইস্পিড ট্রেন চালু হচ্ছে না? এটি চালু করা গেলে, ঢাকা-যশোর, ঢাকা-কলকাতা কিংবা ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। বাংলাদেশ-ভারত যদি কানেক্টিভিটির কথা চিন্তা করে, তাহলে তারা বড় আকারে কেন চিন্তা করছে না?

ভারত এখন দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে অন্যান্য অংশের রেল যোগাযোগ চালুর জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট নিতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট থেকে হিলি হয়ে বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ-তুরা পর্যন্ত রেল চলাচল চালু করতে চায় ভারত। রেল সংযোগটি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাকে মেঘালয়ের গারো হিলস এলাকার সঙ্গে যুক্ত করবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শুরুর জন্য মেঘালয়ের কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রের সম্মতি পেয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে।

এছাড়া কলকাতা থেকে গেদে-দর্শনা হয়ে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী দিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট নেয়ার আরেকটি প্রস্তাব দিয়েছে ভারতীয় রেলওয়ে। এ প্রস্তাব এখনো বিবেচনাধীন রয়েছে।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button