প্রস্তুতিতে প্রাণহানি, বিশ্বকাপের কালো অধ্যায়

গাজীপুর কণ্ঠ, খেলাধুলা ডেস্ক : ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনায় মেতে উঠছে সারা বিশ্ব। কাতারের এ আয়োজন উৎসবের আমেজ ছড়িয়েছে কোটি মানুষের মাঝে। তবে ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই আসরের এবারের আয়োজনের পেছনে রয়েছে কালো এক অধ্যায়।
আয়োজনের প্রস্তুতি পর্যায়ে ঘটেছে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হাজারো প্রবাসী শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা।
২০১০ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার পর থেকে খনিজ তেলসমৃদ্ধ দেশটি শুরু করে ব্যাপক প্রস্তুতি। নতুন অবকাঠামো তৈরির অংশ হিসেবে সুবিশাল স্টেডিয়াম, নুতন বিমানবন্দর, অতিথিশালা ইত্যাদির জন্য কাতার বিপুল সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ করে।
বড় সব প্রকল্পের নির্মাণ কাজ সময়মতো শেষ করার জন্য মরিয়া কাতার অপেক্ষাকৃত সস্তা মজুরির অভিবাসী শ্রমিকদের উপর নির্ভর করলেও তাদের কাজ ও আবাসনের পরিবেশের দিকে নজর দেয়নি। ফলে ঘটেছে বহু শ্রমিকের অকাল মৃত্যু।
কতজন মারা গেছে?
বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য কাতার ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার শ্রমিকদের নিয়োজিত করে। এসব দেশেরর শ্রমিকরা বেশি মারা গেছে।
মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। তবে সংখ্যাটি বেশ বড়৷ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সাড়ে ছয় হাজার থেকে ১৫,০০০ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে গত ১০ বছরে, যাদের অধিকাংশই তরুণ। এর মধ্যে ১ হাজার ১৮ জন বাংলাদেশি শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন বলছে, গত ১০ বছরে ৬,৭৫১ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে এই সংখ্যা দিগুণেরও বেশি। কাতারের অফিশিয়াল সুত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই মানবাধিকার সংস্থা বলছে, ১৫,০০০ প্রবাসী শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে গত এক দশকে।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সরকারি পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান বলছে, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতের ২,৭১১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ১,০১৮ শ্রমিক, নেপালের ১,৬৪১, পাকিস্তানের ৮২৪ এবং শ্রীলংকার ৫৫৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এই সময়ে।
কাতারে জনশক্তির অপর দুই বৃহৎ উৎস হলো ফিলিপাইন্স ও কেনিয়া। দেশ দুটি থেকে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের সংখ্যা যুক্ত করলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে।
এছাড়া গত এক বছরে যারা মারা গেছেন তাদের সংখাও জানা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকৃতপক্ষে এ পর্যন্ত কতজন প্রবাসী শ্রমিক কাতারে মৃত্যুবরণ করেছেন তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়।
বিধ্বস্ত পরিবারের অগণিত গল্প
প্রবাসী হিসেবে যারা কাজ করতে যায় তারা সাধারণত গরিব পরিবারের সন্তান৷ অধিকাংশ পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠাতে ঋণ বা কর্জ করতেও দ্বিধা করে না। কেননা, তারা জানেন যে, তাদের সন্তান বিদেশ গিয়ে টাকা উপার্জন করে পাঠাবে। এতে করে ঋণ শোধ হবে আর পরিবারও আর্থিকভাবে উপকৃত হবে।
কিন্তু কাজ করতে গিয়ে যদি তাদের সন্তান মারা যায় তবে তাদের বড় ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হয়।
কাতারে মৃত্যুবরণ করা প্রতিটি পরিবারের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেছে। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে হারিয়ে তাদের অনেকেই দিশেহারা।
এদের মধ্যে আছে বাংলাদেশের ২৯ বছর বয়সি মোঃ শহিদ মিয়া। ২০১৭ সালে কাতারে কাজ করতে যাওয়ার জন্য প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল তার পরিবারকে৷ এ জন্য টাকা ধার করতে হয়।
তার অকাল মৃত্যু তার পরিবারকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। এই অর্থের বোঝা এখন তার বাবা-মাকে বহন করতে হবে। কাতার থেকেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ।
স্বাভাবিক মৃত্যু?
কিন্তু এসব মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দাবি করেছে বিশ্বকাপ আয়োজক দেশটি আর তা নিয়েও রয়েছে সমালোচনা।
গার্ডিয়ানের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের যতজন মারা গেছেন, তাদের শতকরা ৬৯ ভাগের স্বাভাবিক মৃত্যু ও ১২ ভাগের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায়। শুধু ৭ ভাগের মৃত্যুর সঙ্গে কাজের পরিবেশ জড়িত। আর ৭ ভাগ কর্মী করেছেন আত্মহত্যা।
তবে বেশিরভাগ মৃত্যুর ক্ষেত্রেই মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়নি। আবার দেশটি এত বড় সংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যুর ব্যাপারে কোনো ধরনের অনুসন্ধান করেনি৷ ফলে মৃত্যুর আসল কারণ চাপা পড়ে যায়।
এদিকে শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বানকেও এড়িয়ে গেছে কাতার।
কাতারে প্রায় ২০ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করে।