দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট ৭ জানুয়ারি, প্রস্তুতি সম্পন্ন

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নানা জল্পনা-কল্পনার পর আগামী ৭ জানুয়ারি (রোরবার) ভোট গ্রহণের তারিখ রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
বুধবার (১৫ নভেম্বর) বিকেলে কমিশন সভা শেষে টেলিভিশন ও বেতারে জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে তফসিল ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এর আগে সকালে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের সার্বিক প্রেক্ষাপট ও প্রস্তুতি তুলে ধরবে ইসি। এরই মধ্যে কমিশন তফসিল ঘোষণার সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
মঙ্গলবার এক বৈঠকে জাতির উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষণের খসড়া অনুমোদন করেছে কমিশন। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজে এই ভাষণ তৈরি করেছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গত বছর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বর্তমান নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনসহ সার্বিক কর্মপরিকল্পনার খসড়া রোডম্যাপ তৈরি করে। সেখানে ২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের সম্ভাব্য দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ওই তারিখটি ধরেই ইসির পরবর্তী কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেওয়া হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররাও ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট এবং নভেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল হবে বলে নানা সময় বক্তব্য দিয়েছেন।
তবে ৪ জানুয়ারি একটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হওয়ায় ভোটের তারিখ একদিন এগিয়ে ৩ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। তবে প্রায় দেড় বছরে পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ভোটের সেই তারিখ থেকে সরে আসে কমিশন। গত ৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর সিইসি প্রথমবারের মতো জানান, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ অথবা দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট হতে পারে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ৭ জানুয়ারিকে ভোটের চূড়ান্ত তারিখ রেখে তপশিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
এ ব্যাপারে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘কমিশন সভা ও তফসিল ঘোষণা কমিশনের এখতিয়ার। বুধবার সকাল ১০টায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।’
চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের বসার তাগিদ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠি তফসিলে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে এক প্রশ্নের জবাবে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, তফসিল ঘোষণার জন্য যত ধরনের প্রস্তুতি দরকার, তার সবই সেরে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এরই মধ্যে তফসিল ঘোষণার জন্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সম্মতিও নিয়ে রেখেছেন তারা।
সূত্র আরও জানায়, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ও ভোটের তারিখ নিয়ে ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সিইসি ও অন্য চার কমিশনার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসি সচিব ছাড়া অন্য কাউকে জানানো হচ্ছে না। এমনকি ইসির সিনিয়র কর্মকর্তারাও অনেক বিষয় জানতে পারছেন না। তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার জন্যই মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তফসিল অনুমোদনের সভা ডাকা হয়নি। বুধবার সকাল ১০টার পরই কমিশন সভা আহ্বান করা হবে। দুপুরের পর যে কোনো সময় সভাটি অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে তফসিল অনুমোদন করা হবে। এর পরই সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সেজন্য তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই ব্যস্ত সময় পার করছে কমিশন। এখন নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক নানা আলোচনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা।
জানা গেছে, তফসিল ঘোষণা না হলেও এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এ কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী অবস্থান সত্ত্বেও নির্বাচন আয়োজন ছাড়া কমিশনের কাছে ভিন্ন কোনো পথ নেই। সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বর্তমান পরিস্থিতি নির্বাচনের সম্পূর্ণ অনুকূল না হলেও কিছু করার নেই বলে মন্তব্য করেন সিইসি নিজেই। চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের সামর্থ্য ও ম্যান্ডেট কোনোটাই কমিশনের নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দলগুলোকেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংকটের সমাধান করে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের পরিস্থিতি সবসময় শতভাগ অনুকূলে থাকে না। তবু সাংবিধানিক দায়িত্ব ও শপথের কারণে নির্বাচন কমিশনকে ভোট আয়োজন করতে হবে।’
ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইনি কাঠামোতে বেশ কিছু সংস্কার করা হয়েছে। সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ হয়েছে। নতুন দলের নিবন্ধনের কাজও শেষ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ১০৩টি। আর ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১৪টিতে দাঁড়িয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। ভোট-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ আরও কিছু কাজ চলমান রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর ভোটকেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা, আসনওয়ারি ভোটার তালিকার সিডি প্রস্তুত ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ঠিক করার কাজ চলছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে পর্যবেক্ষক নিবন্ধন প্রাথমিক ধাপ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। চূড়ান্ত হয়েছে বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালাও। সংবাদ সংগ্রহে মোটরসাইকেলের অনুমতি দিয়ে সাংবাদিক নীতিমালাও সংশোধন করা হয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, এবার নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন ৯ লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটা, নির্বাচনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ভাতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাতা মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ হবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে। এর বাইরে নির্বাচনী প্রশিক্ষণে খরচ হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি।
সূত্র জানায়, গত একাদশ সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন মোট ৬ লাখ ৮ হাজার সদস্য। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ভোটকেন্দ্রে থাকেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। ভোটকেন্দ্রের বাইরে থাকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ডের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। তবে এবার সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হবে কি না, এখনো সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।
প্রার্থীদের মনোয়নপত্র দাখিলে যে কোনো জটিলতা এড়াতে এবারের নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। সেইসঙ্গে ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে জামানতের টাকা পরিশোধের সুযোগও থাকছে। অন্যদিকে ভোটকেন্দ্রের নাম ও ভোটার নম্বর খুঁজে পাওয়ার ভোগান্তি কমাতে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করছে কমিশন। এই অ্যাপে ভোটারের তথ্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার (এসপি) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পরিচয় ও ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্র: কালবেলা