মামলায় বিচার পাওয়া বেশ দুরূহ, দিন চলে যায় বিচারের আশায়
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে বিচার পাওয়া বেশ দুরূহ বিষয়। অধিকাংশ মামলায়ই শেষ পর্যন্ত আসামিরা সাজা পান না। বরং বিচারপ্রার্থীদেরই জীবন হয়ে ওঠে আরো দুর্বিষহ। যারা বিচার পান, তাদেরও পোড়াতে হয় অনেক কাঠ-খড়।
ময়মনসিংহের গৌরিপুর উপজেলার শফিকুল ইসলাম ২০১১ সালে ২৩ বছর বয়সের তরুণ। ভাগ্যের চাকা ফেরাতে মালয়েশিয়া যাওযার জন্য আদম বেপারিকে বাবার জমিজমা বিক্রি করে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা দেন। এরপর তাঁকেসহ আরো কয়েকজন তরুণকে ওই আদম ব্যবসায়ীরা মালয়েশিয়া পাঠানোর নাম করে নেপাল পাঠায়। সেখানে কাঠমান্ডুতে কয়েক মাস আটকে রেখে তাঁর কাছ থেকে আরো এক লাখ ৪০ হাজার টাকা নেয় পাচারকারীরা৷ সেখান থেকে অনেক কষ্টে কৌশলে দেশে পালিয়ে আসেন শফিক।
২০১২ সালে তিনি ময়মনসিংহের আদালতে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা দেন। ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনো কোনো তদন্ত প্রতিবেদনই দেয়নি। মূল বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়াতো আরো দূরের কথা।
প্রধান আসামি কাঞ্চণ মিয়াকে পুলিশ মামলার পর গ্রেপ্তার করলেও সে কয়েক দিন পরই জামিনে ছাড়া পায়। বাকি দুই আসামি গ্রেপ্তারই হয়নি। শফিক বলেন, ‘‘আমি এই মামলায় প্রতিমাসেই আদালতে হাজিরা দিই। কিন্তু আসামিদের কোনো খবর নেই৷ এরই মধ্যে আসামিরা আমাকে কয়েকবার ফোন করে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি দেয়।”
তিনি বলেন,‘‘আদালতে যাই, মুহুরিকে টাকা দেই, উকিলকে টাকা দেই। কিন্তু আমার মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। তদন্তের কোনো খবর নেই। মামলা করে, বিচার চেয়ে এখন আমি উল্টো বিপদে আছি।”
ঢাকার মোহাম্মদ ইলিয়াস একইভাবে মামলা করে নিজেই পুলিশি হয়রানির শিকার হয়ে রাগে-ক্ষোভে মামলার কাগজপত্রই ছিঁড়ে ফেলেছেন। ২০১৩ সালে তিনি ঢাকার সিএমএম আদালতে মানবপাচারের মামলা করলে গুলশান থানাকে মামলার তদন্ত দেয়া হয়। পুলিশ উল্টো তাঁকেই মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। ওই মামলায়ও গত ৬ বছরের কোনো আসামি আটক হয়নি৷ তদন্ত রিপোর্টও দেয়নি পুলিশ।
দেশের সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি নৈমিত্তিক চিত্র৷ আদালত পাড়ায় ২০ বছর ধরে বিচার পাওয়ার জন্য ঘুরছেন এমন বিচারপ্রার্থীকেও পাওয়া যাবে।
মামলাজট
মামলা জটও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ৷ ১৮ জুন সংসদে মামলা জটের চিত্র তুলে ধরেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি জানান, দেশের উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন আদালতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭টি। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা ঢাকা জেলায়। বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে মামলা জট নেই।”
এর আগে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার আরেকটি হিসাব দিয়েছিলেন তিনি৷ তখন দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিলো ৩৩ লাখ ৯ হাজার ৭৮৯টি৷ দুই বছরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেড়েছে আরো দুই লাখ।
অপরাধীর শাস্তিহয়না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন আইনের শিক্ষার্থীদের দিয়ে ঢাকার ৫টি ফৌজদারি আদালতের মামলা ওপর জরিপ করান৷ তাতে দেখা যায় কেবল ১০ থেকে ১৫ ভাগ মামলায় আসামিরা শাস্তি পায়। একই ধরনের একটি জরিপে পুলিশ বলছে, শাস্তির হার ১৫ থেকে ২৫ ভাগ।
অধ্যাপক কার্জন বলেন, ‘‘মামলাজটের কারণ বিচারক স্বল্পতা৷ এখন দেশে নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি নয়। এখন যদি আর কোনো নতুন মামলা দায়ের নাও হয়, তাহলেও পেন্ডিং মামলা শেষ করতে ১৬ থেকে ২০ বছর লেগে যাবে। আর ফৌজদারি মামলায় শাস্তির হার কম হওয়ার প্রধান কারণ তদন্ত দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ।”
বাংলাদেশে একটি মামলা দুই থেকে পাঁচ বছরে নিস্পত্তি হওয়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
আইনজীবী তুহিন হাওলাদার তার অভিজ্ঞতায় বলেন, ‘‘এখানে মামলা করে বাদিকেই পীড়নের শিকার হতে হয় বেশি। তার অর্থ খরচ হয়, সময় যায়, তারপরও বিচার মেলে না। নিষ্পত্তি হতে লেগে যায় ১০-১৫ বছর।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে