বিশ্বজুড়ে সামরিক বিশ্লেষকদের নজরে ভারত-পাকিস্তান আকাশযুদ্ধ

গাজীপুর কণ্ঠ, আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চীন-নির্মিত পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ও ফ্রান্সের তৈরি ভারতীয় রাফাল যুদ্ধবিমানের মধ্যে সাম্প্রতিক আকাশযুদ্ধের ঘটনাটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনী। ভবিষ্যৎ সংঘাতে এগিয়ে থাকার কৌশল খুঁজে পেতেই তাদের এই নজরদারি।
গত বুধবার (৭ মে) ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত এই সংঘর্ষে অন্তত দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তা। তাদের দাবি, এই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে চীনে তৈরি পাকিস্তানি জে-১০ যুদ্ধবিমান।
এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা একে চীনের উন্নত যুদ্ধবিমানের জন্য একটি বড় মাইলফলক হিসেবে দেখছেন।
আধুনিক যুদ্ধবিমান, পাইলটের দক্ষতা এবং আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের বিশ্লেষণ ও বাস্তব প্রয়োগের এই সুযোগকে বিরল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এটি বিমানবাহিনীর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার এক বাস্তব অভিজ্ঞতা।
বিশ্লেষকরা জানান, এই সম্ভাব্য যুদ্ধপরিস্থিতিতে আধুনিক অস্ত্রের সক্রিয় ব্যবহার শুধু চীন বা যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন সামরিক মহলে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে চীন-তাইওয়ান এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সম্ভাব্য সংঘর্ষের প্রস্তুতির জন্য এই তথ্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে ইউরোপীয় গ্রুপ এমবিডিএ উৎপাদিত রাডার-নির্দেশিত মেটিওর ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে চীনের পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রের কার্যকারিতা।
যদিও এসব অস্ত্রের ব্যবহার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, তবু এই দুই ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনাকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে চলছে বিশ্লেষণ।
আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস)-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো ডগলাস ব্যারি বলেন, ‘চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশের বিমানবাহিনী এই সংঘর্ষ থেকে বাস্তব তথ্য পেতে ব্যাপক আগ্রহী। তারা কৌশল, পদ্ধতি, প্রযুক্তি ও অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্লেষণ করবে।’
ডগলাস ব্যারি আরও বলেন, ‘যদি এই ঘটনা সত্য হয়, তাহলে বলা যায়, এটি ছিল পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের বিরুদ্ধে চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের একটি সম্মুখ লড়াই।’
তিনি মনে করেন, ফরাসি এবং আমেরিকানরাও ভারতের কাছ থেকে এই সংঘর্ষের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার প্রত্যাশা করছে।
প্রতিরক্ষা শিল্পখাতের একজন নির্বাহী বলেন, ‘পিএল-১৫ একটি বড় সমস্যা। এটি এমন একটি অস্ত্র, যার প্রতি মার্কিন সামরিক বাহিনী অনেক মনোযোগ দেয়।’
এদিকে, রাফাল নির্মাতা ফরাসি কোম্পানি দাসো এভিয়েশন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ফরাসি ছুটির কারণে মেটিওর ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুতকারী এমবিডিএ-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিষ্কার নয়। যেমন—ভারতীয় রাফাল আদৌ মেটিওর ক্ষেপণাস্ত্র বহন করছিল কি না, পাইলটদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল, বা প্রশিক্ষণের মান এবং অপারেশনাল দক্ষতা সংঘর্ষে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে—এসব বিষয় খতিয়ে দেখা জরুরি।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বায়রন ক্যালান বলেন, ‘কোন অস্ত্র কাজ করেছে, কোনটি করেনি, তা বিশ্লেষণ করা হবে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রের বিভ্রান্তিকর বাস্তবতা সবকিছু স্পষ্ট করে না।’
তিনি জানান, ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত তাদের অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে। সেভাবে ভারতীয় অস্ত্রের ইউরোপীয় সরবরাহকারীরাও এবার তথ্য পাবে। একইভাবে পাকিস্তান ও চীনও পারস্পরিক বিশ্লেষণ চালাতে পারে।
পাকিস্তানের হাতে চীনের মূল পিএল-১৫ সংস্করণ না থাকলেও, এর রপ্তানি সংস্করণ থাকার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করেন ডগলাস ব্যারি। এই রপ্তানি সংস্করণের পাল্লা চীনের ব্যবহৃত মূল সংস্করণের তুলনায় কম।
একইসঙ্গে, পিএল-১৫-এর পাল্লা মেটিওরের চেয়ে বেশি কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেকেই এর সক্ষমতা আগের তুলনায় বেশি বলেই মনে করছেন।
তবে মেটিওরের প্রকৃত পাল্লা কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
চীনের পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিমা সামরিক মহলের কাছে বহু বছর ধরেই আগ্রহের বিষয়। এটি চীনের সোভিয়েত-নির্ভরতা থেকে সরে এসে স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রতীক বলেও মনে করা হয়।
এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র লকহিড মার্টিনের মাধ্যমে তৈরি করছে এআইএম-২৬০ জয়েন্ট অ্যাডভান্সড ট্যাকটিক্যাল মিসাইল, যার লক্ষ্য পিএল-১৫-এর সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাওয়া।
অন্যদিকে ইউরোপ মেটিওর ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প চালু করার কথা ভাবছে।
সমরবিষয়ক সাময়িকী জেনস-এর তথ্যমতে, প্রকল্পের আওতায় মেটিওরের ইঞ্জিন ও গাইডেন্স সিস্টেমে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রকল্পের অগ্রগতি খুব ধীর গতিতে চলছে।
সূত্র : রয়টার্স