পুলিশ সংস্কার ও পুনর্গঠন কতদূর?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : করোনা সংকটে পুলিশের কার্যক্রম তুমুল প্রশসংসিত হয়। অন্যদিকে, কক্সবাজারের টেকনাফে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডসহ কিছু ঘটনায় পুলিশের সেই ভাবমূর্তি চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এসব ঘটনায় আবারও সামনে আসে পুলিশে সংস্কারের বিষয়টি। জনবান্ধব, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীন সংস্থা হিসেবে পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে উদ্যোগ নিয়েছিল তখনকার সরকার। দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় আগের উপনিবেশ আমলের আইনের বিভিন্ন ধারা ও বিধি-বিধান সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অধিকার সংরক্ষণ ও গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে পুলিশকে পুনর্গঠন করার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ এবং ইউনাইটেড ন্যাশন্স ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি খসড়া প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল সাবেক আইজিপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ. এস. এম. শাহজাহানকে। এই কমিটি ২০০৭ সালের মে মাসে কাজ শুরু করে। পরে তারা একটি খসড়া সংস্কার আইন জমাও দিয়েছিল। কিন্তু সেই সংস্কার প্রস্তাবনাটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনও এক কক্ষের ফাইল কেবিনেটে সেটি এখন বন্দি হয়ে আছে। কমিটির পক্ষ থেকে একটি খসড়া অধ্যাদেশও প্রণয়ন করে দেওয়া হয়েছিল। আর এ সংস্কার বাস্তবায়নের কোনও লক্ষণও দেখছেননা সংশ্লিষ্টরা। তবে পুলিশ সদর দফতর বলছে, প্রস্তাবিত সংস্কার আইনটি বাস্তবায়ন না হলেও সময়ের প্রয়োজনে পুলিশের সংস্কার প্রতিনিয়তই হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, ইউএনডিপির সহায়তায় খসড়া প্রণয়ণ কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর পুলিশ সদর দফতর থেকে সেটি প্রায় এক যুগ আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (পুলিশ) নেতৃত্বে একটি যাচাই-বাছাই কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সেটার সর্বশেষ কী অবস্থা আর জানা যায়নি। এখনও সেই অবস্থাতেই আছে বলে জানান তারা। কিন্তু এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পুলিশ পুনর্গঠন ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়, যেহেতু মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, জনগনের অধিকার সংরক্ষণ, সংবিধান ও আইন অনুসারে কর্মপরিচালনা এবং জনগনের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণে পুলিশের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ভূমিকা রয়েছে। পুলিশকে পেশাগতভাবে দক্ষ, সেবা নিবেদিত, জনগনের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন, বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত এবং আইন, আদালত ও জনগনের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। পুলিশি ব্যবস্থার নতুন চ্যালেঞ্জসমূহ, আইনের শাসন ও সুশাসনের নীতিসমূহ বিবেচনা করে পুলিশের ভুমিকা, কর্তব্য ও দায়িত্ব পুনঃসংজ্ঞায়িত করা সমীচীন। দক্ষতার সঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ, উদঘাটন ও দমন, জন শৃঙ্খলা শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য পুলিশ পুনর্গঠন প্রয়োজন।

পুলিশ পুনর্গঠনে অধ্যাদেশ প্রণয়নের যৌক্তিকতা তুলে ধরে খসড়া আইনে আরও বলা হয়, যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশ একটি অতি পুরাতন পুলিশ আইন নিয়ে চলছে। যা আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য উপযুক্ত নয়। উপনিবেশিক আমলে পুলিশ ছিল প্রভুদের সেবাদাস। আর স্বাধীনতা উত্তরকালে গত কয়েক যুগ যাবত রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা অবৈধ প্রভাবের মাধ্যমে পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছে। পুলিশ সার্ভিসের ভিতরে ও বাইরে পুলিশী ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের অসন্তোষ ও মোহমুক্তি এখন স্বীকৃত বিষয়। ক্ষমতাসীনদের অবৈধ যন্ত্র থেকে রূপান্তর করে জনগণের সেবায় নিবেদিত একটি পুলিশ সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

খসড়ায় আরও বলা হয়, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে অতীতে পুলিশ সার্ভিস এর মুখ্য উদ্দেশ্য ‘জনগণের সেবা করা’ থেকে বিচ্যুত হয়েছিল বলে মনে করে পুলিশ পুনর্গঠন কমিটি। তাই বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন পুলিশ আইন প্রয়োজন। পুলিশের কাজ হচ্ছে দেশের জনগণের সেবা করা, ক্ষমতাসীনদের নয়। শক্তি প্রয়োগ থাকবে ন্যূনতম। আইন প্রয়োগের নামে নানান বেআইনী উপায়ের ব্যাপক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয়ের মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ সার্ভিসে পেশাদারিত্ব সংরক্ষণে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও সম্পর্কিত ভিত্তিতে মেধার ভিত্তিতে হতে হবে। কাজের ভিত্তিতে পুলিশের মূল্যায়ন হবে।

পুলিশের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, এগুলো হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখছিনা। কারণ, সব রাজনৈতিক দলই চায়, পুলিশকে সঙ্গে রাখার জন্য। এটা দুনিয়ার সব জায়গাতেই হয়। আমাদের মতো দেশে একটু বেশি হয়। সংস্কার বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যা দেখানো হয়েছিল সেই হিসেবে পুলিশ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে পুলিশ কি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ আছে?

তিনি আরও বলেন, সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অপারেশনাল কাজগুলো যেন পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। যেমন একটি মামলা দায়ের, তদন্ত ও নিষ্পত্তি পর্যন্ত যেন কোন হস্তক্ষেপ না হয়। তাছাড়া ‍পুলিশের পোস্টিং, প্রমোশন যেন প্রপারলি হয়, যারা যোগ্য, প্রশিক্ষিত, কর্মক্ষম ও সততা আছে ওইসব লোকগুলো যেন প্রমোশন পান, এসব বিষয়গুলো ছিল। অবশ্য এগুলো বর্তমানে হচ্ছে কিছু কিছু। যেমন আগে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রভাব বিস্তার করত। এখন সেগুলো হচ্ছে না। এটা ভালো দিক। এখন টাকা নিয়ে যদি আপনি পুলিশে একজন লোককে নিয়োগ দেন, তখন তার মাথায় থাকবে সেই টাকা উদ্ধার করা। এই জায়গাটা এখন অনেক ভালো।

পুলিশের সিনিয়র লেভেলে এখন যারা দায়িত্বে আছেন, অনেক রেঞ্জেই তারা চেষ্টা করছেন স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য। তাছাড়া দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে চাইবেন পুলিশকে তো এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই।

পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগের এআইজি মো. সোহেল রানা বলেন, ইউএনডিপির সহায়তায় পুলিশের যে সংস্কার কর্মসূচি শুরু করা হয়েছিল সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।

তিনি বলেন, পুলিশের সংস্কার একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। প্রতিনিয়তই আমরা নানারকম সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তারপরেও আমাদের বর্তমান ইন্সপেক্টর জেনারেল দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পুলিশকে ঢেলে সাজাতে ব্যাপক সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছেন। এখানে আমাদের নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন থেকে শুরু করে কাজের মান এবং সার্বিক বিষয়ে কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। যার ফলে পুলিশ অধিকতর জনবান্ধব ও গণমূখী হবে। এতে সেবার মান আরও উন্নত হবে।

সোহেল রানা আরও বলেন, বর্তমান পুলিশ প্রধান দায়িত্ব নেওয়ার পরদিন থেকেই পাঁচটি মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করছেন। সেই লক্ষ্যগুলো হচ্ছে জিরো করাপশন, জিরো ড্রাগ, নো টর্চার, ডিসিপ্লিন ও ওয়েলফেয়ার এবং বিট পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে পুলিশিং সেবাকে জনগনের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাওয়া।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button