অন্য আলেকজান্ডারের কীর্তি

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত : ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুসন্ধানকে প্রাচ্যবিদ বা পুরাবিদদের হাত থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকদের হাতে পৌঁছে দিয়ে সরকারি সহায়তায়, সংঘবদ্ধভাবে এবং বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে প্রত্ন অনুসন্ধান সম্ভব হয়েছিল আলেকজান্ডার কানিংহামের দৌলতে। সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে ১৮৩০-এর দশকে এ দেশে আসেন কানিংহাম। কর্মসূত্রে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোরাঘুরির সুযোগে ভারতের বহু প্রাচীন স্থাপত্য ছবি, মুদ্রা ইত্যাদির সংস্পর্শে তিনি আসতে পেরেছিলেন। ১৯৩৪ থেকে শুরু করে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতে শুরু করেন এশিয়াটিক সোসাইটিতে। এভাবেই প্রিলেপের সঙ্গে যোগাযোগ গাঢ় হতে থাকে। ১৮৫০-৫১-এ গোয়ালিয়র নেটিভ স্টেটের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র নিযুক্ত হন কানিংহাম। পুরাতত্ত্বে আগ্রহী কানিংহাম এ সময়ে সাঁচির স্তূপ এবং মধ্য ভারতের অন্যান্য বহু প্রাচীন স্থাপত্য বিশদে দেখে নেন। ১৮৫২-এ একই পদে মুলতানে পাঠানো হয় কানিংহামকে। দুই বছর পর বদলি করা হয় বার্মায় এবং আরো বছর দুয়েক পরে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। এভাবে নানা জায়গায় কাজ করতে গিয়ে আলেকজান্ডার কানিংহাম শুধু সেখানকার প্রত্নক্ষেত্রগুলো দেখেই আসেননি, নিবিড় অনুসন্ধানও চালিয়ে আসতে পেরেছিলেন এ দেশের বেশির ভাগ প্রত্নক্ষেত্রে।

সিপাহী বিদ্রোহের পর কোম্পানির শাসন শেষ হয়ে শুরু সম্রাজ্ঞীর রাজত্বকাল। ভারতবর্ষে প্রথম ভাইসরয় হয়ে এলেন লর্ড ক্যানিং। তাকে পুরাকীর্তি অনুসন্ধান ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। কানিংহাম নিযুক্ত হলেন সরকারি সমীক্ষক। বেতন মাসে সাড়ে চারশ টাকা আর রাহা খরচ ও মাঠে-ঘাটে থাকার জন্য মাসে আরো সাড়ে তিনশ। এছাড়া আর কোনো আর্থিক বরাদ্দ রইল না। সেনাবাহিনীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিজের পছন্দসই কাজে যোগ দিলেন কানিংহাম। তখন তার ৪৭ বছর বয়স। এ বয়সে পৌঁছার অনেক আগেই ধরাধাম ত্যাগ করতে হয়েছিল উইলিয়ম জোন্স বা জেমস প্রিন্সেপকে।

আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রধান হয়ে কানিংহাম যত সমীক্ষা করেছিলেন, সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে কানিংহাম’স রিপোর্ট নামে পরিচিত ২৩ খণ্ডে প্রকাশিত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে রিপোর্টসে। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, আলেকজান্ডার কানিংহামের অবদান শুধু এ রিপোর্টগুলো দিয়ে পরিমাপ করা যায়, তাহলে কিন্তু খুব ভুল হবে।

১৮৫০-এর দশকে হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণের বিবরণের ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বৌদ্ধ যুগের প্রাচীন নিদর্শনগুলি খুঁজে পেতে আলেকজান্ডার কানিংহাম চেষ্টা করতেন চৈনিক পরিব্রাজকদের চরণরেখা খুঁজে তাকে অনুসরণ করতে। এ পন্থায় অনুসন্ধান চালিয়ে কানিংহামের প্রথম সাফল্য আসে সংকাশ্যে। অবশ্য সংকাশ্যর উল্লেখ তিনি পেয়েছিলেন ফা-হিয়েনের বিবরণে। সেনাবাহিনীতে থাকার সময়েই তার চৈনিক পর্যটকের লেখা সেং-কিয়া-শি খোঁজা হয়ে যায়।

শুধু প্রাচীন স্থাপত্য বা তার ধ্বংসাবশেষই নয়, কানিংহাম খুঁজে ফিরতেন প্রাচীন মুদ্রাও। মুদ্রায় দেখা যাওয়া লিপি এবং চিত্রের মধ্য দিয়ে বোঝার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। ১৮৩৯-এ কাশ্মীর গিয়ে সহস্রাধিক মুদ্রা সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খুঁজে পাওয়া বা কেনা এবং তাদের বৈচিত্র্য প্রসঙ্গে তিনি বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন সারা জীবনে। ২৩ ভলিউম রিপোর্টের মতো এ প্রবন্ধগুলোও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

উত্তর ভারতে এবং বিহারে কোসাম্বি, অযোধ্যা ও নালন্দায় প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছিলেন কানিংহাম। নালন্দায় প্রত্নক্ষেত্র অবশ্য ফ্রান্সিস বুকানন আগেই দেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি যে নালন্দা, তা তার জানা ছিল না। রাজগিরের কয়েক মাইল উত্তরে অবস্থিত ধ্বংসাবশেষটিকে কানিংহাম শনাক্ত করেন বিখ্যাত নালন্দা মহাবিহার হিসেবে। হিউয়েন সাঙের বলা অ-ইউ-টো যে অযোধ্যা সে কথা বুঝতে পারেন কানিংহাম। অবশ্য এখানে সম্রাট অশোকের স্থাপন করা স্তূপ বা স্তম্ভ পাওয়া যায়নি। স্তম্ভের ওপরের বেল-ক্যাপিটাল শুধু দেখতে পেয়েছিলেন। শৈব মন্দির নাগেশ্বরনাথে শিবলিঙ্গের নিচের অংশ হিসেবে সেটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। দেখা যাচ্ছে, ভুবনেশ্বরে ভাস্করেশ্বর মন্দিরের স্তম্ভের অংশকে শিবলিঙ্গে পরিণত করা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এমন হয়তো আরো ঘটেছে। দেহরাদুন থেকে আরো খানিক উত্তরে, সুদূর কালসিতে কানিংহাম যে লিপির সন্ধানে গিয়েছিলেন সেটি অবশ্য চীনা তীর্থযাত্রীদের বিবরণে উল্লিখিত হয়নি। এটির খবর কানিংহাম পেয়েছিলেন আরেক ইংরেজ মিস্টার ফরেস্টের কাছ থেকে। কালসির প্রস্তরলিপির ওপরের অংশে একটি দাঁতাল পুরুষ হাতির ছবি খোদাই করা হয়েছিল। অশোকের লিপির সঙ্গে হাতির মূর্তি বা চিত্র হিসেবে এটি তৃতীয়। আগেরগুলো হলো ধৌলি ও সংকাশ্যর লিপি। এগুলোর থেকে পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হবে বৌদ্ধদের বিশ্বাসে হাতি হলো বুদ্ধদেবের প্রতীক। ১৮৬৫ ও ১৮৬৬-এর শীতে উত্তর পাঞ্জাবের মানিকিয়ালা স্তূপে এবং প্রাচীন নগরী তক্ষশীলার বিভিন্ন সৌধে অনুসন্ধান চালান এবং অন্ধকার থেকে আলোয় আসে বহু অজানা তথ্য।

আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের প্রধান নিযুক্ত হওয়া থেকে চার-পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে ভারতবর্ষের উত্তর দিকের অংশে কানিংহাম ১৬০টি প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান, শনাক্তকরণ ও সমীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও লর্ড ক্যানিং দেশে ফিরে যাওয়ার পর যখন লর্ড লরেন্স এলেন ভাইসরয় হয়ে, কানিংহামকেও ফিরতে হলো ইংল্যান্ডে। সরকারি বাজেটে কাটছাঁট করতে গিয়ে প্রত্নসন্ধানের বা সংরক্ষণের বরাদ্দ বন্ধ করে দিল সরকার। ইংল্যান্ডে গিয়ে কানিংহাম অবশ্য মিলিটারির পেনসনভোগী হয়ে বসে থাকলেন না। লিখে ফেললেন ‘দি অ্যানসিয়েন্ট জিওগ্রাফি অব ইন্ডিয়া: দ্য বুড্ডিস্ট পিরিয়ড’ বইটি। ১৮৬৯-এ লর্ড লরেন্সের জায়গায় সম্রাজ্ঞীর প্রতিনিধি হয়ে এলেন লর্ড মেয়ো। তার দুই বছরের মধ্যে কানিংহামকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হলো আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডাইরেক্টর জেনারেল করে। ততদিনে অবশ্য তিনি আর রিটায়ার্ড লেফটেন্যান্ট নন, হয়েছেন নাইট কমান্ডার অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার। অর্থাৎ স্যার আলেকজান্ডার।

দুই সুযোগ্য ও দক্ষ সহকারীকেও পেলেন কানিংহাম ১৮৭১-এ ফিরে এসে। তারা হলেন আর্মেনীয় ইঞ্জিনিয়ার জোসেফ বেগলার ও ইংরেজ শিক্ষক আর্চিবল্ড কার্লাইল। বুন্দেলখণ্ড, মালওয়া, বেসনগর বা প্রাচীন বিদিশা, এরান, শৃঙ্গবেরপুর, মহাভারতের দ্রুপদ রাজার রাজধানী কাম্পিল্য, মধ্যভারতের দেওগড় ও ভিতরগাঁওয়ের মন্দির, বর্তমান ছত্তিশগড়ে অবস্থিত রাজিম, সিরপুর, ভোরামদেও প্রভৃতি এলাকার মন্দির, সাহারানপুরের অদূরে সিরসাওয়া, পাঞ্জাবের পশ্চিমে শাহজি কি দেহরি, হিমাচলের চাম্বা আর মানডি, প্রভৃতি অসংখ্য জায়গায় প্রচুর প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেন কানিংহাম এবং তার দুই সহকারী। মালওয়ায় রানী রূপমতীর স্মৃতিবিজড়িত মাণ্ডু, সারংপুর, প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাচীন সৌধ যেমন সংরক্ষণ করেছিলেন স্যার আলেকজান্ডার, তেমনই সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেন লোকমুখে প্রচলিত বেশকিছু গান, যেগুলোর রচয়িতা রূপমতী। ছত্তিশগড়ের ভোরামদেও মন্দিরের নির্মাণকাল, সেখানে অধিষ্ঠিত দেবতা ও নির্মাতা রাজবংশের পরিচয় সম্পর্কিত বিশদ তথ্য যথাবিহিত প্রমাণসহ দাখিল করেছিলেন কানিংহাম।

স্যার আলেকজান্ডারের প্রিয় প্রত্নক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মথুরা। তিনি বারবার ফিরে আসতেন এ প্রাচীন শহরে এবং তার উপকণ্ঠে। পার্কহ্যাম থেকে মৌর্য যুগের বিশাল যক্ষের মূর্তিটিও কানিংহামের খুঁজে পাওয়া। মথুরার স্তূপের রেলিংংের প্রতিটি স্তম্ভে খোদিত একটি করে নারীর মূর্তি ও খাজুরাহোর নারী মূর্তিগুলির তুলনামূলক বিচার করে ভারতবর্ষে মূর্তি নির্মাণের শৈলীর পরিবর্তন সম্পর্কে বিশদ আলোকপাত করেন কানিংহাম।

১৮৭১ থেকে একটানা ১৫ বছর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডাইরেক্টর জেনারেলের দায়িত্বভার বহন করেন সামলান কানিংহাম। কিন্তু তার দপ্তরে তিনি থাকতেন না বললেই চলে। তাকে পাওয়া যেত অকুস্থলে, যেখানে প্রত্নসন্ধানের কাজ চলছে, কিংবা কাজ চলছে কোনো প্রাচীন সৌধের সংরক্ষণ। শেষ পর্যন্ত ১৮৮৫ সালে অবসর নিলেন তিনি। এও এক ধরনের স্বেচ্ছাবসর। বোধহয় শরীর আর দিচ্ছিল না।

বম্বের বন্দর থেকে ১৮৮৫-এর সেপ্টেম্বরে এসএস ইন্দাস জাহাজে ইংল্যান্ড অভিমুখে রওনা হলেন ভারতবর্ষে সংঘবদ্ধভাবে প্রত্নসন্ধানের প্রাণপুুরুষ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম। সঙ্গে নিয়ে চললেন এ দেশ থেকে সংগৃহীত প্রত্নসামগ্রীর বিপুল সম্ভার। ভারহুতের সতূপের রেলিং ও তোরণ, অমরাবতীর মার্বেল ফলক, প্রভৃতি মিউজিয়মে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন কানিংহাম। চেয়েছিলেন সাঁচীর ভাস্কর্যগুলোকেও কোনো মিউজিয়মে সরিয়ে নিয়ে যেতে। সে কাজ অবশ্য করতে পারেননি। পারলেন না তার সঙ্গে থাকা প্রত্নসামগ্রীগুলোকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে। শ্রীলংকার উপকূলের কাছাকাছি ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ইন্দাস জাহাজ ডুবে গেল। সেই সঙ্গে সলিল সমাধি হলো কানিংহামের সঙ্গে থাকা যাবতীয় জিনিসপত্রর। অবশ্য স্বর্ণ বা রুপার তৈরি প্রত্নসামগ্রী আগেই অন্য জাহাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেগুলো এখনো আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। জাহাজডুবিতে কানিংহাম অবশ্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি মারা যান আরো আট বছর পরে। লন্ডন শহরে।

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত: ‘প্রত্নতথ্য: ভারতবর্ষের প্রত্নক্ষেত্র সন্ধানের আশ্চর্য কাহিনী’ গ্রন্থের লেখক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button