১৪ বছরেও ‘তেলে-জলে’ মিশে আছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বিচার বিভাগ পৃথক ঘোষণার ১৪ বছর পার হচ্ছে আজ। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা ঘোষণা করা হয়। রায়ের ১২ দফা নির্দেশনার আলোকে ওই ঘোষণা আসে। এই ১৪ বছরে ১২ দফার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ দু-একটি নির্দেশনার পুরোপুরি, কোনোটার আংশিক বাস্তবায়ন হয়নি। যে নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি সেগুলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে করেন সংশ্লিষ্টরা। রায়ে হাইকোর্ট বলেছিলেন তেলে-জলে মেশে না, বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে এক করা যাবে না। কিন্তু ১৪ বছর পরও অনেকটা তেলে-জলে মিশেই চলছে বিচার বিভাগের ‘স্বাধীনতা’।
১২ দফা নির্দেশনার প্রথম দফায় বলা হয়, বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের কাজের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। সাধারণ জনপ্রশাসনের সঙ্গে বিচার ক্যাডারকে মেশানো যাবে না। রায়ে বলা হয়, তেলে-জলে মেশে না, সেভাবে বিচারকদের সরকারি কর্মচারী বানানো যাবে না। কারণ, বিচারকরা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। কিন্তু ১৪ বছর পরের বাস্তবতা হলো, তেলে-জলে এখনো মিশেই আছে। এখনো দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিরাজমান বিচার বিভাগে। বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা বিধানে বিচার বিভাগের পাশাপাশি নির্বাহী বিভাগও দায়িত্বপ্রাপ্ত। চালু রয়েছে প্রেষণ ব্যবস্থাও। অনেক বিচারক প্রেষণে নির্বাহী বিভাগে চাকরি করছেন।
রায়ের দ্বিতীয় দফা অনুযায়ী বিচারক নিয়োগে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন করা হয়েছে। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ সৃষ্টি, নিয়োগ পদ্ধতি, নিয়োগ বদলিসহ অন্যান্য কাজের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবেন। এ বিধিমালাও হয়েছে। তৃতীয় দফার নির্দেশনা অনুযায়ী বিসিএস (বিচার) ক্যাডার বিলুপ্ত করা হয়েছে। চতুর্থ দফাও বাস্তবায়ন হয়েছে। এতে বলা হয়, রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন এবং এ সংক্রান্ত বিধিমালা করতে হবে। এ কমিশনে সুপ্রিমকোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। কমিশনে নারী ও পুরুষ বলে কোনো বৈষম্য থাকবে না।
পঞ্চম দফায় বলা হয়, সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন। এটি বাস্তবায়ন হলেও নিয়ন্ত্রণ কিছুটা প্রশাসনের হাতে রেখেই করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ষষ্ঠ দফা অনুযায়ী জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং পৃথক পে-কমিশনও করা হয়েছে।
সপ্তম দফায় বলা হয়েছে, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের থাকবে। নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের সঙ্গে বিরোধ হলে সব সময় সুপ্রিমকোর্টের মত প্রাধান্য পাবে। আপাতদৃষ্টে এটিরও বাস্তবায়ন হয়েছে। অষ্টম দফায় বলা হয়, কর্মস্থলে বিচারকের মেয়াদ ঠিক থাকবে। তাদের বেতনসহ অন্যান্য ভাতার নিরাপত্তা থাকবে। সংসদ ও সরকারের সঙ্গে আদালত ব্যবস্থার সম্পর্ক থাকবে না, বরং প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে। তবে নতুন বিধিতে পরতে পরতে প্রাতিষ্ঠানিক পরাধীনতার রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নবম দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এ বাজেট সুপ্রিমকোর্ট প্রণয়ন ও বরাদ্দ করবে। এ আদেশেরও বাস্তবায়ন হয়েছে। ১০ম দফায় বলা হয়, বিচারকদের বিষয় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে বিচার্য হবে। এটি কার্যকর হয়েছে। ১১তম নির্দেশনায় বলা হয়, পৃথকীকরণকে অধিকতর অর্থপূর্ণ, সুস্পষ্ট, কার্যকর ও সম্পূর্ণ করতে সংবিধান সংশোধন করার সদিচ্ছা সংসদ দেখাবে। কিন্তু এই ১৪ বছরেও সংসদ তা করেনি। ১২তম নির্দেশনায় বলা হয়, অন্যান্য ক্যাডারের মতো বিচারকরাও সমান আর্থিক সুবিধা পাবেন। কিন্তু এটির লঙ্ঘন ঘটছে। ভাতা, গাড়ি ঋণ সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে বিচারকেরা নির্বাহী বিভাগের তুলনায় বৈষম্যের শিকার।
অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে বিচারক মাজদার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ১৯৯৫ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। ১৯৯৬ সালের ১৩ জুন থেকে দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ১৯৯৭ সালের ৭ মে ঐতিহাসিক রায় দেন। এর বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর রায় দেন। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রায়টি বাস্তবায়ন করে। আনুষ্ঠানিকভাবে ওই বছরের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে পৃথক ঘোষণা করা হয়।
পৃথক ঘোষণার ১৪ বছর পর মূল্যায়ন জানতে চাইলে মাসদার হোসেন মামলার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমির উল-ইসলাম বলেন, বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানের যে বিধি করা হয়েছে, সেটি হাইকোর্ট বিভাগকে দিয়ে করার জন্য আমি আবেদন জানিয়েছিলাম। আবেদনটি নামঞ্জুর করা হয়। পরবর্তীতে যে বিধি আপিল বিভাগ অনুমোদন করে, সেটি বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের ভারসাম্য বাধাগ্রস্ত করেছে। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার বিধান রয়েছে এতে। এ জন্য আপিল বিভাগের এ সংক্রান্ত আদেশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করা প্রয়োজন।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, কোনো সরকারই বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্ত্বা দিতে চায়নি। এখনো বিচার বিভাগে দ্বৈতশাসন চলছে। অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রিমকোর্ট মিলে অধস্তন আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে বলা ছিল, অধস্তন আদালত থাকবে সুপ্রিমকোর্টের অধীনে। কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য আমাদের অপেক্ষা দীর্ঘতর হচ্ছে।
সূত্র: আমাদের সময়