নাম-পরিচয় পাল্টে ১৪ বছর আত্মগোপনে ফাঁসির আসামি, অবশেষে ধরা পুলিশের হাতে

নিজস্ব সংবাদদাতা : কালীগঞ্জের আলোচিত মহিউদ্দিন (১৫) হত্যা মামলার পর পুলিশের চোখে ফাঁকি দিতে নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় নূরুল ইসলাম (২৭)। এর কয়েক বছর পর নিজের ও বাবা-মায়ের নামসহ ঠিকানা পরিবর্তন করে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দিব্যি আত্মগোপনে থেকে বসবাস শুরু করেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। অপরদিকে তার সহযোগীদের কয়েকজন খাটছেন সাজা। কিন্তু মৃত্যু পরোয়ানা নিয়েই নূরুল ইসলাম দেশের বিভিন্ন এলাকায় রিকশা চালিয়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করছিলেন বছরের পর বছর ধরে। এভাবে প্রায় ১৪ বছর কেটে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।

শুক্রবার (৫ মে) ভোর ৪ টার দিকে ময়মনসিংহের গলগন্ডা এলাকায় থেকে নূরুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

গ্রেপ্তার নূরুল ইসলাম কালীগঞ্জের ব্রাহ্মণগাঁও এলাকার বাচ্চু মোল্লার ছেলে।

থানা সূত্রে জানা গেছে, এর আগে একই হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আরেক আসামি শফিকুলকে ঘটনার প্রায় ১৪ বছর পর গত রোববার (৩০ এপ্রিল) দিবাগত রাতে পাবানার রূপপুর এলাকা থেকে ঈশ্বরদী থানা পুলিশের সহায়তায় গ্রেপ্তার করে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ সোমবার সকালে গাজীপুর আদালতে পাঠিয়েছে।

জানা গেছে, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূরুল ইসলাম পালাতক থাকা অবস্থায় সর্বশেষ ময়মনসিংহের গলগন্ডা এলাকার একটি গ্যারেজে থেকে রিকশার চালাতেন। প্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের সহায়তায় ময়মনসিংহের কোতোয়ালী মডেল থানার গলগন্ডা এলাকায় থেকে নূরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে কালীগঞ্জ থানায় আনা হয়। পরবর্তীতে মামলার বাদীসহ স্থানীয়রা শনাক্ত করেন গ্রেপ্তার নূরুল ইসলামই মহিউদ্দিন হত্যা মামলার পলাতক আসামি। পরে শুক্রবার দুপুরে তাকে গাজীপুর আদালতে পাঠানো হয়।

gazipurkontho

আরো জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর মহিউদ্দিনকে হত্যার পর মামলা দায়েরে হলে পুলিশের চোখে ফাঁকি দিতে নিজ এলাকা ব্রাহ্মণগাঁও ছেড়ে পালিয়ে যায় নূরুল ইসলাম। এর কয়েক বছর পর নিজের ও বাবা-মায়ের নামসহ ঠিকানা পরিবর্তন করে শেরপুর থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। এরপর আত্মগোপনে থেকে বসবাস শুরু করেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এর মধ্যেই বিয়ে করেন নরসিংদী সদর থানা এলাকায়। তার একটি সন্তানও রয়েছে। রিকশা চালিয়ে সে  বৌ-বাচ্চা নিয়ে দিব্যি আত্মগোপনে সংসার করছিলেন। এভাবে প্রায় ১৪ বছর কেটে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে সর্বশেষ ময়মনসিংহের গলগন্ডা এলাকার একটি গ্যারেজ থেকে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের সহায়তায় নূরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ।

ঘটনা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর কালীগঞ্জের ব্রাহ্মণগাঁও এলাকার ফজলুর রহমানের ছেলে মহিউদ্দিনের মোবাইলে ফোন আসে। এরপর সে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। পর দিন স্থানীয় ময়েজ উদ্দিনের বাড়ির পাশে একটি বিলে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জখম হওয়া তার মরদেহ পাওয়া যায়। খবর পেয়ে কালীগঞ্জ থানার পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। পরে নিহতের বাবা ফজলুর রহমান বাদী হয়ে কালীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্ত শেষে পুলিশ পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১০জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই (বুধবার) দুপুরে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১ আদালতের বিচারক মো. ফজলে এলাহী ভূইয়া হত্যার দায়ে ৫ জনকে ফাঁসির আদেশ এবং একই সঙ্গে প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- ব্রাহ্মণগাঁও এলাকার আব্দুল কাদিরের ছেলে শামীম, বাচ্চু মোল্লার ছেলে নূরুল ইসলাম, মজনু সরকার ওরফে মজলু সরকারের ছেলে সাদ্দাম হোসেন, আব্দুস ছালামের ছেলে শফিকুল ও ছমির উদ্দিনের ছেলে বাবু।

রায় ঘোষণার সময় সাদ্দাম হোসেন ও বাবু আদালতে উপস্থিত থাকলেও অপর তিন আসামি পলাতক ছিলেন। এর মধ্যে নূরুল ইসলামকে ঘটনার প্রায় ১৪ বছর পর গ্রেপ্তার করা হলো। এখনো একজন পলাতক রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেছিলেন তৎকালীন এপিপি মকবুল হোসেন কাজল, আতাউর রহমান খান, আব্দুল করিম (ঠান্ডু)। আসামি পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. হানিফ শেখ ও বেগম জেবুন্নেছা মিনা।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছিলেন, হত্যাকাণ্ডের দুই মাস আগে নিহত মহিউদ্দিনকে দুবাই পাঠানোর জন্য কাউলতিয়া গ্রামের শরীফকে ৪০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এর দুই বছর আগে মহিউদ্দিনের ভাই সৌদি প্রবাসী ইমান আলী একটি ক্যামেরা মোবাইল পাঠিয়েছিল। ওই মোবাইল ফোনটি বেশিরভাগ সময় মহিউদ্দিন ব্যবহার করতো। ঘটনার দিন বিকেলে তার মোবাইলে একটি কল আসলে সে বাড়ি থেকে বের‌ হয়। পরে আর বাড়ি ফেরেনি। এরপর দিন সকালে স্থানীয় ময়েজউদ্দিনের বাড়ির পূর্ব পাশের একটি বিলে মহিউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে।

এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়েছিল, প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিরোধে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। ওই মামলার আসামিরা বিভিন্ন ধরণের হুমকি দিয়ে আসছিল। এতে সে সময় তাদের ধারণা করা হয়েছিল, জমি সংক্রান্ত বিরোধে মহিউদ্দিনকে হত্যার পর মোবাইল নিয়ে যায় বিরোধ থাকা প্রতিবেশীদের ভাড়াটে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা।

সত্যতা নিশ্চিত করে কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নুরুল ইসলাম জাতীয় পরিচয় পত্রে নিজের নাম ঠিকানা পরিবর্তন করেও নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ও প্রযুক্তির সহায়তায় কালীগঞ্জ থানা পুলিশের অভিযানে পলাতক নুরুল ইসলামকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার বাদীসহ স্থানীয়রা শনাক্ত করেছে গ্রেপ্তার নূরুল ইসলামই যে মহিউদ্দিন হত্যা মামলার পলাতক আসামি।

ওসি মোহাম্মদ ফায়েজুর রহমান আরো জানান, গ্রেপ্তার নরুর ইসলাম তার নাম পরিবর্তন করে ফারুক মিয়া এবং পিতার নাম রফিক মিয়া ও মায়ের নাম নাসরিন বেগম উল্লেখ করে শেরপুর পৌরসভার  দক্ষিণ নৌহাটা এলাকায় নিজের স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে এতো দিন আত্মগোপনে ছিল। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ৭৮১৪৮৬৪৯৫ এবং জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১০ জুলাই ১৯৯৬ সাল।

 

আরো জানতে….

কালীগঞ্জের আলোচিত মহিউদ্দিন হত্যা: ১৪ বছর পর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button