শেষ ওভারের হ্যাটট্রিক নাটকের পর বাংলাদেশের জয়

গাজীপুর কণ্ঠ, খেলাধুলা ডেস্ক : শুক্রবার বিকেল থেকেই স্টেডিয়ামের পথে দর্শকের স্রোত। খেলা শুরু হতে হতেই গ্যালারি প্রায় পূর্ণ। দেশের জার্সি গায়ে হাজার হাজার দর্শক, হাতে হাতে পতাকা আর স্লোগানে প্রকম্পিত চারপাশ। ৫ বছর পর সিলেটে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ম্যাচ বলে কথা! স্টেডিয়ামের ভেতর-বাহিরে সাজ সাজ রব। সেই আবহ পরে আরও রাঙিয়ে তুললেন তাওহিদ হৃদয় ও শামীম হোসেন। আষাঢ়ের শেষ রাতটিতে গ্যালারিতে নেমে এলো যেন আনন্দের বৃষ্টি। বাংলাদেশের দারুণ জয়ে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম হয়ে উঠল উৎসবের আঙিনা।

দুই ম্যাচ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথমটিতে শুক্রবার আফগানিস্তানকে ২ উইকেটে হারিয়ে সিরিজে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।

কাঙ্ক্ষিত সেই মুহূর্তটির আগে অবশ্য নাটক কম হলো না। জয় যখন একদম মুঠোয়, তখনই তা প্রায় ফসকে যাচ্ছিল। ৫ বলে যখন প্রয়োজন স্রেফ ২ রান, টানা তিন ব্যাটসম্যানের আত্মঘাতী শটে হ্যাটট্রিক করে বসেন করিম জানাত। বাংলাদেশ পড়ে যায় শঙ্কায়। তীরে এসে তরী ডোবার ঘটনা তো বাংলাদেশের ক্রিকেটে কম নেই!

শেষ পর্যন্ত হতাশার পুনর্জন্ম হয়নি। পঞ্চম বলে চার মেরে উল্লাসে ফেটে পড়েন শরিফুল ইসলাম। গর্জন ওঠে গ্যালারিতে।

জয়সূচক শটটি শরিফুলের ব্যাট থেকে এলেও বাংলাদেশের রান তাড়ার মূল নায়ক হৃদয়। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ানডে দলের বড় ভরসা হয়ে ওঠা তরুণ ব্যাটসম্যান এবার ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেললেন টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়া জুটিতে তার সঙ্গী শামীম। ২০২০ যুব বিশ্বকাপজয়ী দলের দুই ব্যাটসম্যান!

১৫৫ রান তাড়ায় যখন একাদশ ওভারে বিদায় নেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের জয়টাকেও মনে হচ্ছিল নাগালের বাইরে। কিন্তু হৃদয় আর শামীমের অসাধারণ জুটি সেই লক্ষ্যকেই নিয়ে আসে কাছে। স্কিল, সাহস আর আত্মবিশ্বাসের দারুণ প্রদর্শনীতে ৪৩ বলে ৭৩ রানের জুটি গড়েন দুজন।

২৫ বলে ৩৩ রান করে বিদায় নেওয়া শামীম পারেননি কাজ শেষ করতে। কিন্তু হৃদয় ভুল করেননি।

শেষ ওভারে যদিও ভুল করে বসেন অন্য তিন জন। ৬ বলে ৬ রানের সমীকরণে প্রথম বলটিই বাউন্ডারিতে পাঠান মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু দ্বিতীয় বলে পুল করে তিনি ক্যাচ তুলে দেন শর্ট মিউ উইকেটে।

পরের ডেলিভারিতে স্টাম্পের অনেক বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন তাসকিন আহমেদ। এরপর নাসুম আহমদ গিয়ে উইকেট হারান পুল করার চেষ্টায়। জানাতের হ্যাটট্রিকে যখন অভাবনীয় কিছু আশায় উড়ছেন আফগানরা, হৃদয় ভাঙার শঙ্কায় তখন স্তব্ধ গোটা গ্যালারি।

তবে এরপর আর পা হড়কায়নি। হৃদয় অপরাজিত থাকেন ৩২ বলে ৪৭ রান করে।

শেষের ওই নাটকীয়তার আগে বাংলাদেশের রান তাড়ার শুরুটাও ছিল বাজে। প্রথম ওভারেই ফজলহক ফারুকির বল রনি তালুকদারের ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে উড়িয়ে দেয় অফ স্টাম্প।

পরের সময়টায় দ্রুত রান তুলতে ব্যর্থ হন লিটন কুমার দাস ও নাজমুল হোসেন শান্ত। একটি ছক্কা মারলেও শান্ত বিদায় নেন ১২ বলে ১৪ করে। লিটন একদমই ছন্দ পাচ্ছিলেন না। বারবার ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আর পুল করার চেষ্টায় টাইমিং করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত এভাবেই উইকেট বিলিয়ে আসেন ১৯ বলে ১৮ রান করে।

সপ্তম ওভারে বাংলাদেশের রান তখন ৩ উইকেটে ৩৯।

১০ ওভার পেরিয়ে যেতেই সাকিব যখন উইকেট উপহার দিলেন ফরিদ আহমাদকে, জয়টাও যেন দূরে সরে যায়। সেখান থেকেই হৃদয় ও শামীমের সেই জুটি।

৮ ওভারে যখন প্রয়োজন ৭৬ রান, খেলার মোড় ঘুরে যায় তখনই। আজমতউল্লাহ ওমারজাইয়ের এক ওভারে তিনটি চার মারেন হৃদয় ও শামীম মিলে, সঙ্গে ওয়াইড বলে চারসহ ওভার থেকে আসে ২১ রান।

পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে এরপর দলকে জয়ের কাছে নিয়ে যান তারা।

টস হেরে আগে ব্যাট করে আফগানিস্তান অবশ্য তাদের প্রত্যাশিত স্কোরই পেয়েছিল। টসের সময় আফগান অধিনায়ক রশিদ খান বলেছিলেন, দেড়শ রানের আশেপাশে চোখ তাদের। সেটি তারা করতে পারে।

যদিও শুরুটা তারা ভালো করতে পারেননি তারাও। নাসুম আহমেদকে স্লগ সুইপে ছক্কা মারার পরের বলেই বিদায় নেন হজরতউল্লাহ জাজাই। তাসকিন আহমদকে পুল করে ছক্কায় উড়িয়ে পরে তার বলেই ফেরেন রহমানউল্লাগ গুরবাজ।

দুই ওপেনারকে অনুসরণ করেন ইব্রাহিম জাদরানও। তিনে নামা ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যান শরিফুল ইসলামকে ছক্কা মারার পরের বলে। এই নিয়ে পাঁচবারের দেখায় প্রতিবারই ইব্রাহিমকে আউট করলেন এই বাঁহাতি পেসার।

পাওয়ার প্লেতে আফগানিস্তান তোলে ৩ উইকেটে ৪০ রান। একটু পর করিম জানাতকে ফিরিয়ে আফগানদের আরও চেপে ধরেন সাকিব আল হাসান।

নবির লড়াই অবশ্য ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই তিনটি বাউন্ডারি মারেন তিনি শরিফুলকে। পরে মনোযোগ দেন ইনিংস গড়ে তোলায়। নাজিবউল্লাহ জাদরানের সঙ্গে তার ৩৫ রানের জুটিতে সরে যায় চাপ।

২৩ রান করা নাজিবউল্লাহকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে আফগানিস্তান ততক্ষণে ঝড় তোলার ভিত পেয়ে গেছে।

ষোড়শ ওভারে একশ পেরোয় আফগানরা। পরের ৪ ওভারে উত্তাল হয়ে ওঠে নবি ও আজমতউল্লাহ ওমারজাইয়ের ব্যাট। তাসকিনকে গ্রিন গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেন নবি, চোখধাঁধানো র‌্যাম্প শটে ছক্কায় ওড়ান ওমারজাই।

পরে মুস্তাফিজের স্লোয়ারকে সীমানা ছাড়া করেন ওমারজাই। পার পাননি এমনকি সাকিবও। প্রথম ৩ ওভারে স্রেফ ১৩ রান দেওয়া বাংলাদেশ অধিনায়কের শেষ ওভারে টানা দুটি ছক্কা মরেন ওমারজাই। ১৮ বলে ৩৩ করে ওই ওভারেই তিনি বিদায় নেন তাসকিনের দারুণ ক্যাচে।

শেষ ওভারে পূর্ণ হয় নবির ফিফটি। টি-টোয়েন্টি পঞ্চাশের স্বাদ পেলেন তিনি ৩৪ ইনিংস পর। সবশেষটি করছিলেন বাংলাদেশের বিপক্ষেই, ২০১৯ সালে ৫৪ বলে অপরাজিত ৮৪। এবার তিনি অপরাজিত থাকেন ৪০ বলে ৫৪ রানে।

শেষ ৪ ওভারে রান আসে ৫৩। আফগানদের রান পৌঁছে যায় দেড়শ ছাড়ানোর প্রত্যাশিত সীমানায়। কিন্তু জয়ের আশা তাদের পূরণ হয়নি। শেরে নাটকীয়তার পর বাংলাদেশের জয়ে সিলেটের দর্শকদের উল্লাস চলতে থাকে ম্যাচ শেষের অনেক পরও।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

আফগানিস্তান: ২০ ওভারে ১৫৪/৭ (জাজাই ৮, গুরবাজ ১৬, ইব্রাহিম ৮, করিম ৩, নবি ৫৪*, নাজিবউল্লাহ ২৩, ওমারজাই ৩৩, রশিদ ৩, মুজিব ০*; নাসুম ৩-০-২০-১, তাসকিন ৪-০-২৯-১, শরিফুল ৩-০-৩০-১, সাকিব ৪-০-২৭-২, মুস্তাফিজুর ৪-০-৩১-১, মিরাজ ২-০-১৩-১)

বাংলাদেশ: ১৯.৫ ওভারে ১৫৭/৮ (লিটন ১৮, রনি ৪, শান্ত ১৪, সাকিব ১৯, হৃদয় ৪৭*, শামীম ৩৩, মিরাজ ৮, তাসকিন ০, নাসুম ০, শরিফুল ৪*; ফারুকি ৪-০-৩৬-১, মুজিব ৪-০-২২-১, ওমরজাই ৩-০-৩৪-১, রশিদ ৪-০-২৪-১, ফরিদ ২-০-১৭-১, নবি ১-০-৮-০, করিম ১.৫-০-১৫-৩)।

ফল: বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী।

সিরিজ: ২ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ১-০তে এগিয়ে।

ম্যান অব দা ম্যাচ: তাওহিদ হৃদয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button