তালেবান সরকারের ‘মন জয়’ করতে চায় ভারত?

গাজীপুর কণ্ঠ, আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সম্প্রতি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এবং ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রী মুখোমুখি হন। এই বৈঠকটি বেশ কয়েকটি দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে, কারণ এতে আফগান তালেবান সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতির সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন— এটি কাবুল ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির লক্ষ্যে প্রথম উঁচু পর্যায়ের যোগাযোগ।

গত বছরের মধ্যে ভারত আফগান তালেবান সরকারের সঙ্গে ধাপে ধাপে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছে। তবে, দুবাইয়ের এই বৈঠকটি এ পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে, ভারত তালেবান সরকারকে কূটনৈতিকভাবে মান্যতা দিতে এবং আফগানিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান করতে চায়।

ভারত ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যার মধ্যে নির্মাণ এবং সহায়তা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। বৈঠক শেষে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে আঞ্চলিক উন্নয়ন, বাণিজ্য ও মানবিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা এবং আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য ও শরণার্থী খাতে সহায়তার বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে।

এদিকে, এ বৈঠকটি এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিমান হামলা নিয়ে ভারতের নিন্দা ছিল। গত মাসে পাকিস্তানি বিমান হামলায় অন্তত ৪৬ জন নিহত হওয়ার পরই ভারত-তালেবান বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো। এই হামলা এবং বৈঠক দুটি সম্পর্কের মধ্যে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তনের আভাস দিতে পারে, যা ভবিষ্যতে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় তৈরি করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে— ভারতীয় কূটনীতি আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের শাসনের শুরু থেকেই সতর্ক ও সুদূরপ্রসারী ছিল। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর, ভারতীয় সরকার জানিয়ে দিয়েছিল যে, তালেবান সরকারকে উপেক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ভারত তার কূটনৈতিক নীতি এবং আফগান জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বহাল করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

এছাড়া, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ২০২২ সালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আফগানিস্তানে আবার ছোট আকারে একটি কারিগরি দল পাঠিয়েছিল এবং গত নভেম্বরে তালেবান সরকার মুম্বাইয়ে তাদের একটি প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে। এই নিয়োগটি তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তালেবান সরকার ইতিমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশকে তাদের প্রতিনিধিদের কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, তবে ভারত তাদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে একটু ধীরে এগিয়েছে। এখন, ভারত একে একে তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার চেষ্টা করছে।

ভারতের জন্য তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের অধীনে থাকা বাস্তবতা ভারতের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে, যেহেতু ভারত আফগানিস্তানে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত রাখতে চায়। আরেকটি বিষয় হলো, তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি হলে ভারতের অবস্থান শক্তিশালী হতে পারে, বিশেষ করে আফগান নাগরিকদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য ও পর্যটনের মতো ভিসা সুবিধাগুলি পুনরায় চালু করার ক্ষেত্রে।

তবে, ভারতের কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়ে কিছু প্রশ্নও উঠছে। বিশেষ করে, আফগানিস্তানে নারীদের জন্য শিক্ষা সংক্রান্ত বিধিনিষেধের বিষয়ে ভারত কতটা সক্রিয়, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই মনে করেন, আফগানিস্তানে নারী অধিকারের বিষয়টি নিয়ে ভারতকে আরও সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। ভারতের এই নীরবতা তার আন্তর্জাতিক ইমেজের জন্য কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারত নিজের স্বার্থ বজায় রাখতে চাইছে। তানিজা, কবির, একজন ভারতীয় গবেষক বলেন, তালেবান এখন ভারতের জন্য এক বাস্তবতা এবং আফগানিস্তান ও আফগান সরকারকে উপেক্ষা করা কোনো বিকল্প হতে পারে না। তবে, রাঘব শর্মা, ভারতের আরেক গবেষক বলেন, তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে ভারত সরাসরি খোলামেলা হতে চাইছে না, তবে এটি পূর্ববর্তী যোগাযোগের ধারাবাহিকতা।

ভারতের এই কূটনৈতিক পদক্ষেপের ফলে, আফগানিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের পথে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যদিও রাজনৈতিক, মানবিক এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাগুলো মোকাবিলা করা এখনো সহজ কাজ নয়। সূত্র: আল-জাজিরা

Related Articles

Back to top button