কালীগঞ্জের পুলিশ হত্যায় বিতর্কিত চার্জশিট: বাদ পড়েছে নির্দেশদাতা কাদের চেয়ারম্যান?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে সহকর্মী হত্যায় প্রশ্নবিদ্ধ চার্জশিট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। হত্যাকারীদের বাঁচাতে বদলে ফেলা হয়েছে সাক্ষীদের জবানবন্দি। এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যও আমলে নেয়া হয়নি। এভাবেই তৈরি করা চার্জশিট থেকে বাদ পড়েছে হত্যার নির্দেশদাতাসহ ২৯ আসামির নাম। এ ছাড়া আসামিদের বাঁচাতে চার্জশিটে দায়সারা কারণ উল্লেখসহ রাখা হয়েছে নানা ফাঁকফোকর। এর ফলে মামলার বিচার শুরু হলে অনেকে পার পেয়ে যেতে পারেন- এমন আশঙ্কা নিহতের পরিবার ও পুলিশের অনেকের।

কালীগঞ্জ থানার নায়েক আজিজুর রহমান হত্যা মামলায় সম্প্রতি এমনই অবিশ্বাস্য এবং নজিরবিহীন চার্জশিট আদালতে জমা পড়েছে। ২৫ আগস্ট অতি গোপনে এই চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া হয়। কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল কাদের (হত্যার নির্দেশদাতা) ও তার সহযোগীদের বাঁচাতে এমনই বিতর্কিত অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক রেজাউল করিম। সহকর্মী হত্যায় এমন চার্জশিট দেখে পুলিশের অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১১ মে কালীগঞ্জের বড়কাউ বাজারের পাশে অভিযানে গিয়ে খুন হন নায়েক আজিজুর রহমান। ওই ঘটনায় কালীগঞ্জ থানার তৎকালীন এসআই কামরুল হাসান বাদী হয়ে আবদুল কাদেরসহ ৫৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলার নথি পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এর আগে আরও পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেছেন। ওই পাঁচ কর্মকর্তা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে ১৬১ ধারায় ৪০ জন পুলিশ সদস্যের জবানবন্দি নেন। তাদের মধ্যে অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া কালীগঞ্জ সার্কেলের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) শাহরিয়ার আল মামুনও রয়েছেন। তারা সবাই আবদুল কাদেরকে নির্দেশদাতা উল্লেখ করে জবানবন্দি দেন। মামলার ষষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম নতুন করে ১৬১ ধারায় ৮ পুলিশ সদস্যের জবানবন্দি নেন। রহস্যজনক কারণে তারা আগের দেয়া জবানবন্দি থেকে সরে আসেন। নতুন জবানবন্দিতে তারা আবদুল কাদের ও তার ২৭ সহযোগীর নাম বাদ দেন। এ কারণে ষষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তের বিষয়ে খোদ পুলিশের কর্মকর্তারাই প্রশ্ন তুলেছেন।

মামলার বাদী এসআই কামরুল হাসান (বর্তমানে নবাবগঞ্জ থানায় কর্মরত) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘সাক্ষীদের সঙ্গে কথা না বলেই জবানবন্দি বদলে দেয়া হয়েছে। আমি মামলার বাদী। অথচ আমাকে তদন্তের ফলাফল জানানো হয়নি। পুলিশের ওপর হামলার নির্দেশদাতা ছিলেন আবদুল কাদের। তাকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয়ার বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।’

এদিকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক রেজাউল করিম। রোববার তিনি বলেন, তদন্তে যেসব তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তার ভিত্তিতেই চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এ হামলার সঙ্গে আবদুল কাদেরের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এ বিষয়ে কারও কিছু বলার থাকলে তারা আদালতে বলতে পারবেন। সেই সুযোগ তো আছেই। সাক্ষীর জবানবন্দি বদলে দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলে নতুন করে সাক্ষীদের জবানবন্দি নিতে হয়। নতুন করে জবানবন্দিতে সাক্ষীরা যা বলেছেন তার ভিত্তিতেই চার্জশিট দেয়া হয়েছে। সাক্ষীরা প্রথমদিকে হামলাকারীদের হয়তো চিনতে পারেনি, পরে তারা জানতে পেরেছে ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত।

গাজীপুর জেলা ডিবির ওসি আমির হোসেন বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলতে পারবেন। তিনি তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

নিজের জবানবন্দি বদলে দেয়ার বিষয়ে পুলিশ সদস্যরা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তারা হলেন : কালীগঞ্জ থানার তৎকালীন এসআই ইয়াছিন আলী, এএসআই পিন্টু সরকার, এএসআই দেলোয়ার হোসেন, কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল (বর্তমানে এএসআই) মোজাম্মেল হক, কনস্টেবল মেহেদী হাসান, কনস্টেবল রফিকুল ইসলাম এবং কনস্টেবল ওয়ারেছ ভূঁইয়া।

জবানবন্দি বদলে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াছিন আলী (বর্তমানে কামরাঙ্গীর চর থানার পরিদর্শক) বলেন, এ বিষয়ে কিছু বলতে চান না। যা বলার তিনি আদালতে বলবেন।

এএসআই পিন্টু সরকার বলেন, তিনি তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। পুলিশ সদস্য মোজাম্মেল হক বলেন, তার সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম যোগাযোগই করেননি। নতুন জবানবন্দির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

হামলার নির্দেশ দেন কাদের : মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাক্ষী হিসেবে প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত ৪০ জন পুলিশ সদস্যের জবানবন্দির বিষয়ে কোনো গুরুত্বই দেননি তদন্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম। অভিযানে নেতৃত্বে থাকা কালীগঞ্জ সার্কেলের তৎকালীন এএসপি (বর্তমানে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার) শাহরিয়ার আল মামুন ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারি কাজে বাধা প্রদান করার অভিযোগে দায়ের করা দুটি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ছিলেন কাদের ও তার সহযোগীরা। আসামিদের ধরতে ২০১৩ সালের ১০ মে রাতে কাউখালী বাজার এলাকায় তার নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই সময় তিনি জানতে পারেন, সন্ধ্যায় তুরাগ নদের পাড়ে কাদের, তার চাচাতো ভাই মজিবুর রহমান পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে। আসামিদের গ্রেফতার করতে ফোর্স নিয়ে তিনি মধ্যরাতে বড়কাউ বাজারের প্রধান রাস্তা এলাকায় যান। এ সময় তুরাগপাড় থেকে কাদের বাহিনী পুলিশের ওপর হামলা করে। আবদুল কাদের চিৎকার করে হামলার নির্দেশ দিলে সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের এলোপাতাড়ি কোপে নায়েক আজিজুর রহমান মারা যান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহরিয়ার আল মামুন বলেন, ‘কাদের চেয়ারম্যানের নির্দেশে সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হামলায় নায়েক আজিজুর নিহত হন।

এদিকে নাগরী ইউনিয়নের পাঁচজন চৌকিদার নুরু মিয়া, নকুল চন্দ্র মণ্ডল, মহিউদ্দিন, চানমোহন মণ্ডল এবং সুদর্শন মণ্ডল তাদের ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, আবদুল কাদের এবং তার চাচাতো ভাই মজিবুর রহমান ২০১৩ সালের ১০ মে সন্ধ্যায় তুরাগ নদের তীরে পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন।

বাদ গেল কাদেরসহ ২৮ জন :

চার্জশিট থেকে বাদ যাওয়া আসামিরা হলেন : আবদুল কাদের, তার ছেলে অর্ণব, হোসেন মিয়া, মো. শাহিন, মোফাজ্জল ওরফে মোবা, শাহজাহান সরকার, আলাউদ্দিন সরকার, আকরামুল, মো. জামান, লিটন মিয়া, রফিকুল মিয়া, সুরুজ মিয়া, সিরা মিয়া, হারেস, মোমিন, আলাউদ্দিন, আতিকুল, আরিফ, আতিক সরকার, এরশাদ, পটু, মোহাম্মদ আলী, মাসুদ, ফজলু, নজরুল, দীপু, শরীফ, রব মিয়া এবং কামাল উদ্দিন। তাদের মধ্যে ফজুল মারা গেছেন। অন্যরা সবাই কাদেরের সহযোগী।

আসামি করা হয়েছে যাদের :

চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন : মজিবুর রহমান, সায়েদুল ওরফে সায়েদ, নজরুল ইসলাম, মারফত, জাহিদুল ইসলাম, মো. রোমান, বিপ্লব, বদির, ফাইজুল, নূরা, কাইয়ুম, হাবিবুল্লাহ, হারুন, মোতালিব, সাহাবুদ্দিন, হাবিবুল, আবুল হোসেন মাস্টার, সেলিম, কবির, নজরুল, দবির, সেলিম, সোলায়মান, আমান, শাহজাহান এবং মোশারফ হোসেন। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের দাবি, চার্জশিটে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং যাদের বাদ দেয়া হয়েছে তারা সবাই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মহলবিশেষের হস্তক্ষেপে প্রধান আসামিদের রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button