রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৩ শতাংশই ওষুধে

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : মৌসুমি রোগের চিকিৎসায় মানুষের যে ব্যয় তার ৬৩ শতাংশই চলে যায় শুধু ওষুধ কিনতে। যদিও এ খাতে ব্যয় পার্শ্ববর্তী দেশ ও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ওষুধের অযাচিত ব্যবহার, সচেতনতার অভাব ও চিকিৎসকদের বেশি ওষুধ প্রেসক্রিপশন করার প্রবণতা এক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর্থসামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে দুটি মৌসুমে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের এ বিভাজন উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।

ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর চিকিৎসা ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডে মোট চিকিৎসা ব্যয়ের মধ্যে ওষুধ বাবদ মানুষের খরচ ১০ শতাংশের নিচে। অন্য দেশগুলোর বেশির ভাগেই মৌসুমি রোগে মানুষের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ২০ শতাংশ যায় ওষুধ খাতে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ খাতে ব্যয় ৩০ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইন ফোকাস: ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আর্থসামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে বিভিন্ন আয়ের মানুষ মৌসুমি রোগের চিকিৎসায় গড়ে ১৩ হাজার ১৪৩ টাকা ব্যয় করে। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যয়, ওষুধ, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা, পরিবহন ও অনান্য খাতে এসব ব্যয় করতে হয় একজন অসুস্থ রোগীকে। এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার ২৬৬ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে শুধু ওষুধ কেনায়। মৌসুমি রোগের চিকিৎসায় মানুষের যে ব্যয় হয়, ওষুধ বাবদ ব্যয় তার ৬২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দুই মৌসুমের মধ্যে বর্ষাকালে ওষুধ বাবদ চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় ৬১ শতাংশ চলে যায়। শীতকালে এ ব্যয়ের হার প্রায় ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে বর্ষাকালের চেয়ে শীতকালে ওষুধে বেশি ব্যয় হচ্ছে। মৌসুমভেদে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ে পার্থক্য রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে নিম্ন আয়ের মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ চলে যায় ওষুধ কিনতে। অন্যদিকে উচ্চবিত্ত মানুষের এক্ষেত্রে ব্যয় হয় ৫৯ শতাংশ। শীতকালে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ খরচ করে ওষুধ কিনতে। এক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের ব্যয় ৬১ শতাংশ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব এলাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা রয়েছে সেসব এলাকায় অপচিকিৎসা বেশি হয়। এতে ওষুধের প্রয়োগ বেশি হয়। চিকিৎসা তখন ওষুধনির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে ওষুধ গ্রহণ ছাড়া মানুষের অন্য কোনো উপায় থাকে না। একই সঙ্গে চিকিৎসক ও ওষুধ ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতার অনুপস্থিতিতে ওষুধে খরচ বেশি হচ্ছে। অতি মুনাফার লোভে স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা অনৈতিকতার আশ্রয় নিচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য খরচের বেশির ভাগই ওষুধে ব্যয় হচ্ছে। দেশে অঞ্চলভেদে এ খরচের হার কম-বেশিও হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, প্রয়োজনীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অভাব ও অকার্যকারিতায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গ্রামে অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে মানুষ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পায় না। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যেসব ওষুধ দেয়া হয় তার বেশির ভাগ প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেয়া সাধারণ ওষুধ। অধিকাংশ হাসপাতালই পূর্ণ কোর্সের ওষুধ রোগীদের সরবরাহ করে না। এসব নানা প্রতিকূলতায় ওষুধের ওপর নির্ভরতার পাশাপাশি এ খাতে মানুষের ব্যয়ও বাড়ছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির (এইচআরএমএনসি) সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তায়ন, চিকিৎসকদের অনৈতিকতাসহ অতি মুনাফালোভীদের কারণে ওষুধে রোগীদের বেশি খরচ করতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা যত বেশি ওষুধ লিখবেন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে তত সুবিধা পাবেন এমন বিষয় রয়েছে। তাদের কেউ তো জবাবদিহিতার আওতায় নেই। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, অপ্রয়োজনীয় রোগ নিরীক্ষণের কারণে খরচ বাড়ছে। ওষুধের ফার্মেসির ব্যক্তিরাও ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ দিচ্ছে। এতে রোগীরা চিকিৎসকের কাছেও যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান না শেখা, ভারসাম্যহীন জীবনযাপন, ব্যক্তিজীবনের অভ্যাস, খাদ্যাভ্যাসের কারণে আমাদের এখানে ওষুধের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। এর উল্টো চিত্র উন্নত দেশগুলোতে। তাই তাদের ওষুধে খরচও কম করতে হয়। বাংলাদেশে মানুষের আয় যখন আরো বাড়বে তখন ওষুধে খরচ কমবে। কারণ তখন তাদের সামাজিক অবস্থার আরো পরিবর্তন হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটির নিয়ন্ত্রণ।

ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানির ওষুধ বিক্রি ও ধরন নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তি ও ক্লিনিক্যাল গবেষণার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে ওষুধের বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকায়। বাজারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ওষুধের এ বাজারের ৭১ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে ১০ কোম্পানি। আর যে ওষুধের ওপর ভর করে বাজার বড় হচ্ছে তার সর্বাগ্রে রয়েছে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরস বা অ্যাসিডিটির ওষুধ। সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধের তালিকায় এর পরই আছে অ্যান্টিবায়োটিক। মোট বিক্রীত ওষুধের ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ অ্যাসিডিটির। অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে এ হার ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অ্যাসিডিটি, অ্যান্টিবায়োটিকের পরই দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ডায়াবেটিসের ওষুধ। ইনজেকশন আকারে ব্যবহূত এ ওষুধের হিস্যা মোট বাজারের ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের মোট বিক্রীত ওষুধের প্রায় ২৫ শতাংশই দখল করে আছে অ্যাসিডিটি, অ্যান্টিবায়োটিক ও ডায়াবেটিস। আর এসব ওষুধ মানুষজন নিজেদের ইচ্ছামতো কিনতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেন। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীও।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বাংলাদেশে ওষুধ এতটাই সহজলভ্য যে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এখানে ওষুধ কেনা যায়। আবার অনেক সময় চিকিৎসকরাও বেশি ওষুধ দেন। শিশুদের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক, বয়স্কদের জন্য মাত্রার বেশি ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম, রোগ নিরীক্ষণের দুর্বলতার কারণে এটি হতে পারে। একই সঙ্গে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের বাইরেও রোগীকে ওষুধের পরামর্শ দেন ফার্মেসির ফার্মাসিস্টরা। এটা চূড়ান্ত মাত্রার অনৈতিকতা। আমাদের দেশে ওষুধ বিক্রির বিষয়ে যে নীতি রয়েছে তার প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণ থাকলে এ পরিস্থিতি হতো না।

সাধারণ কোনো রোগের উপসর্গ দেখা দিলে ওষুধের দোকান থেকে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) বা ব্যবস্থাপত্রবিহীন ওষুধ কেনার সুযোগ রয়েছে। এ ধরনের ৩৯টি ওষুধ কেনার সুযোগ থাকলেও দেশে প্রায় সব ধরনের ওষুধই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রির চর্চা দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ ব্যবহারে মানুষের আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গ্লোবাল হেলথ এক্সপেন্ডিচার ডাটাবেজ বলছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়নের সিংহভাগ মূলত রোগীর নিজের পকেট থেকে আসে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার খরচের ৭৪ শতাংশ রোগীর নিজস্ব উৎস থেকে আসে। বিশ্বে গড় রোগীর বাড়তি খরচ ৩২ শতাংশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় রোগীর বাড়তি খরচ সবচেয়ে বেশি।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, দেশে অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক ও হারবাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে ৭৫৬টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অ্যালোপ্যাথিকের ৩১ হাজার ওষুধ রয়েছে। এসব ওষুধ পৌনে চারশ মডেল ফার্মেসি এবং ৩২ হাজার মডেল মেডিসিন শপ ও ১ লাখ ৩৮ হাজার ওষুধের দোকানের মাধ্যমে মানুষের হাতে পৌঁছে।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিআলসারেন্ট, ভিটামিন বেশি গ্রহণ করা হচ্ছে। এসবের বিক্রি বেশি, দামও বেশি। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এসব ওষুধ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবু নিয়ম না মেনে বিক্রি হচ্ছে এসব ওষুধ। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল রেজিস্ট্যান্স। অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিট্যান্স গড়ে উঠেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। ওষুধ বিক্রি ও ব্যবহারের বিষয়ে যে নীতিমালা রয়েছে তা প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল মাজিদ বলেন, আমাদের দেশে ওষুধের দোকান অনেক বেশি। একটি বাজারে সর্বোচ্চ দুটি ওষুধের দোকান থাকতে পারে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলেও একই স্থানে ডজনের ওপরে দোকান থাকে। ওষুধের দোকান যেখানে সেখানে হতে পারে না, এমন ধারণাই নীতিনির্ধারকদের নেই। দেশে ৩৯টি ওটিসি, ২৮৫টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ এবং প্রায় ৩০ হাজার ওষুধ রয়েছে। মোট চৌদ্দশ জেনেরিকের ওষুধ রয়েছে। এগুলো ওষুধের দোকানের মাধ্যমে মানুষের হাতে পৌঁছে।

মানুষ নিজের ইচ্ছায় ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করছে বলে ওষুধের ব্যবহার বেশি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, মানুষ অযোগ্য মানুষের কাছ থেকে ওষুধের পরামর্শ নিচ্ছে। যাদের ওষুধ ও রোগ সম্পর্কে ধারণা নেই যেমন—ওষুধের দোকানের কর্মী, কবিরাজ, হাতুড়ে চিকিৎসক, তারাই রোগীকে ওষুধের কথা বলছে। কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসকও ওষুধ দিতে পারেন না।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button