যুদ্ধে উত্থান পুতিনের, পতনও হবে যুদ্ধে

গাজীপুর কণ্ঠ, আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ১৯৯৯ সাল। ওই বছর যুদ্ধই ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষমতায় এনে দেয়। এখন আবার পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধই তার ক্ষমতার পতন ঘটাবে। তিনি ভেবেছেন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাতে পারবেন। কারণ, গত ২২ বছর ধরে আমাদের ব্যর্থতা তাকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, আমরা তার তুলনায় দুর্বল। অনলাইন গার্ডিয়ানে লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জোনাথন লিটেল এক মন্তব্য প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ১৯৯৯ সালের আগস্ট। তখনকার ভ্লাদিমির পুতিন ছিলেন অচেনা এক ব্যক্তি।

তখন তার পূর্বসূরি চেচনিয়ায় পূর্ণাঙ্গভাবে আবার আগ্রাসন চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

এরপর পুতিনের নাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। পুতিনও প্রস্তুত ছিলেন। ফলে শর্তহীন সমর্থন পেয়ে তিনি সেনাবাহিনীর লাগাম খুলে দিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের পরাজয়ে যে রক্তপাত হয়েছিল তার প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনীকে অনুমোদন দেন তিনি। ৩১শে ডিসেম্বর রাতে বর্ষীয়ান এবং ভেঙে পড়া বরিস ইয়েলৎসিন পদত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্সির ক্ষমতা উপহার হিসেবে তুলে দেন নবাগতের হাতে। ২০০০ সালের মার্চে পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চার বছর প্রধানমন্ত্রিত্বে থাকা ছাড়া তিনি পুরোটা সময় রাশিয়াকে শাসন করেছেন।

জোনাথন লিটেল আরও লিখেছেন, যখন দ্বিতীয়বার যুদ্ধ শুরু হয়, তখন একজন সাহায্যকর্মী হিসেবে আমি চেচনিয়া ফিরে যাই। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি সার্গেই কোভালেভ নামের রাশিয়ান একজন মহান মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে নৈশভোজে মিলিত হই। সবার মুখে মুখে তখন উড়ছে এমন একটি প্রশ্ন তার দিকে ছুড়ে দিই- এই অখ্যাত অচেনা প্রেসিডেন্ট কে? পুতিন কে? আমার এখনও স্মরণ আছে কোভালেভ উত্তরে বলেছিলেন- আপনি কি জানতে চান যুবক ভ্লাদিমির পুতিন কে? ভ্লাদিমির পুতিন হলেন কেজিবির একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। আপনি কি জানেন কেজিবির একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কি? আদতে কিছুই না।

কোভালেভ যা বললেন তার অর্থ হলো একজন ব্যক্তি যাকে কখনোই পূর্ণাঙ্গ কর্নেল বানানো হয়নি, তিনি ক্ষুদ্রমনা একজন অপারেটিভ। তিনি একটি বা দুটি বিষয়ের বেশি একসঙ্গে চিন্তা করার সক্ষমতা রাখেন না। পুতিন তার ২২ বছরের ক্ষমতায় নিজের স্ট্যাটাসকে অসীম পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন। আমার মনে হচ্ছে, প্রয়াত কোভালেভ মৌলিক অর্থেই সঠিক ছিলেন।

জোনাথন লিটেল আরও লিখেছেন, কৌশলগত দিক দিয়ে পুতিন নিজেকে মেধাবী প্রমাণ করেছেন খুব তাড়াতাড়ি। বিশেষ করে পশ্চিমাদের দুর্বলতা ও বিভক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। চেচেনদের দমন করতে তার কয়েক বছর সময় লেগেছে। তারপর সেখানে তিনি নিজের পুতুল শাসকগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে তিনি এক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। ন্যাটো ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে সদস্যপদ দেয়ার প্রতিশ্রæতি দেয়ার চার মাস পরে ২০০৮ সালে পুতিন জর্জিয়া সীমান্তে তার সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটান কৌশল হিসেবে। ৫ দিনের মধ্যে ওই দেশে আগ্রাসন চালান। স্বীকৃতি দেন সেখান থেকে ভেঙে আসা দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে। এর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানায় পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো। কিন্তু কার্যত তারা এর বিরুদ্ধে কিছুই করেনি।

রক্তাক্ত এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের জনগণ রাশিয়াপন্থি প্রেসিডেন্টকে ২০১৪ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। ইউরোপের দিক থেকে ওই প্রেসিডেন্ট মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মস্কোমুখী হয়েছিলেন। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরপরই পুতিন দ্রæততার সঙ্গে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে ক্রাইমিয়া দখল করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের এমন একটি ভূখণ্ড প্রথমবার দখল করেন তিনি। যখন আমাদের নেতারা এতে হতাশ হলেন, জেরবার হলেন, তারা নিষেধাজ্ঞা দিলেন। কিন্তু পুতিন দমলেন না। তিনি উস্কানি দিতে লাগলেন ডোনবাসে। এটি রাশিয়ানভাষী ইউক্রেনের এলাকা। সেখানে ইউক্রেনের দুর্বল সেনাবাহিনীকে দমন করতে তিনি নিজের ছদ্মবেশী বাহিনীকে ব্যবহার করলেন। ফলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো দুটি কথিত প্রজাতন্ত্র- দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক।

পুতিনের এসব পদক্ষেপের প্রতিটির নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমারা। তারা তাকে শায়েস্তা করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তা হয়েছে হয়তো হাল্কা অথবা অকার্যকর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুতিনকে নিরুৎসাহী করা। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি দ্বিগুন নিচে নেমে গেলেন। আবারও ফিরলেন।

জোনাথন লিটেল আরও লিখেছেন, শারীরিক গঠনে পুতিন একজন ক্ষুদ্র মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী লেনিনগ্রাদে বড় হয়েছেন। সেখান থেকে পরিষ্কারভাবে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তা হলো- যদি তুমি একটি ক্ষুদ্র বালক হও, তাহলে প্রথমেই আঘাত করো, জোরো আঘাত করো এবং আঘাত করতেই থাক। তাহলেই বড় যেসব বালক আছে, তারা তোমাকে ভয় পাওয়া শিখবে এবং তারা তোমার পিছু নেবে না। এই শিক্ষাই পুতিন হৃদয়ে ধারণ করেছেন। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট ছিল প্রায় ৭৫০০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে ইউরোপের সম্মিলিত বাজেট ছিল ২০০০০ কোটি ডলার। আর শুধু রাশিয়ার বাজেট ছিল ৬৫০০ কোটি ডলার। এখনও আমরা তাকে যতটুকু ভয় পাই, তার চেয়ে বেশি ভয় তিনি আমাদেরকে দেখান। এটা হলো ঘরের কোণে একপেশে হয়ে পড়া ইদুরের লড়াইয়ের মতো।

জোনাথন লিটেল আরও লিখেছেন, পশ্চিমারা যখন ডনবাসে সক্রিয় লড়াই বন্ধে আলোচনায় আগ্রহী, আর আলোচনার টেবিল থেকে ক্রাইমিয়াকে ভুলে যাওয়ার অবস্থা তখন পশ্চিমাদের এই অবস্থা দেখে পুতিন নিশ্চয় আনন্দিত হয়েছেন। তিনি মনে করেছেন এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ক্রাইমিয়াকে অবৈধভাবে দখলকে বৈধতা দিয়েছে বিশ্ব। তিনি দেখেছেন নিষেধাজ্ঞা তার দেশের ক্ষতি করে, তবে তা খুব গভীরভাবে নয়। ফলে তিনি নিজের সেনাবাহিনীকে অব্যাহতভাবে গড়ে তুলতে পারেন আর নিজের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে পারেন। তিনি দেখেছেন ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি তার দেশের গ্যাসের ওপর থেকে ও বাজার থেকে নিজের নির্ভরতা কমাচ্ছে না। তিনি দেখেছেন, এর বিনিময়ে তিনি ইউরোপের রাজনীতিকদের কিনতে পারেন।

এর মধ্যে আছেন জার্মানির ও ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রীরাও। এসব রাজনীতিককে তিনি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানির পরিচালনা পরিষদে বসাতে পারেন। প্রতিবারই তিনি দেখেছেন, যখনই কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন, তখনই পশ্চিমারা নড়েচড়ে উঠেছেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এই তালিকায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন, যুক্তরাষ্ট্রের আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প- এই তালিকা অনেক দীর্ঘ।

জোনাথন লিটেল আরও লিখেছেন, দেশে ও বিদেশে সবখানেই রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যা শুরু করেন পুতিন। যখনই এসব ঘটনা ঘটেছে, তখনই তা নিয়ে আমরা হইচই করেছি। কিন্তু তা ওই পর্যন্তই। তা নিয়ে আর কিছু হয়নি। ২০১৩ সালে বারাক ওবামার সিরিয়ায় রেড লাইন লঙ্ঘন করেন, দামেস্কে বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করেন, তখন তাতে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানান ওবামা। তবে এক্ষেত্রে দৃষ্টি দিয়েছিলেন পুতিন। ২০১৫ সালে তিনি নিজের বাহিনীকে সিরিয়ায় পাঠান। তারতাসে নিজেদের নৌঘাঁটি স্থাপন করেন এবং খামেইমিনে নতুন বিমানঘাঁটি স্থাপন করেন।

পরের সাত বছরে, তার সেনাবাহিনীর জন্য একটি পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেন সিরিয়াকে। তাদের দক্ষতা, কৌশল, সরঞ্জাম ব্যবহারে সমন্বয়, বোমা হামলা, হাজার হাজার সিরিয়ানকে হত্যা, বাশার আল আসাদকে বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করেন তারা।

সর্বশেষ তিনি নিজের কার্ড ইউক্রেনে খেলেছেন। স্পষ্টত তিনি বিশ্বাস করছেন, তিনি ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম পশ্চিমাদের প্রকাশ্যে পরাস্ত করবেন। তিনি আরও বিশ্বাস করেন, আমরা যা করেছি, গত ২২ বছরে তার কাছে তা ব্যর্থ হয়েছে। এতে তিনি এই শিক্ষাই পেয়েছেন যে, আমরা দুর্বল। কৌশলগত দিক দিয়ে পুতিন হতে পারেন জিনিয়াস। কিন্তু তিনি কৌশলগত দিক দিয়ে চিন্তা করতে অক্ষম। আমাদের নেতারা তাকে সত্যিকারভাবে অনুধাবন করা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমাদেরকেও বোঝার জন্য কোনো আগ্রহ তিনি দেখাননি। গত দুই বছরে কোভিড-১৯ এর কারণে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকার পর মনে হচ্ছে ক্রমশ তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন এবং স্লাভিক , সাম্রাজ্যবাদী, অর্থোডক্স আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছেন।

জোনাথন লিটেল আরও লিখেছেন, ইউক্রেনিয়ানদের জন্য তিনি দৃশ্যত নিজের প্রচারণাকেই সত্যিকার অর্থে গলধকরণ করেছেন। তিনি কি মনে করেন, ইউক্রেনিয়ানরা রাশিয়ানদেরকে মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগত জানাবেন? তারা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন? যদি তিনি এমনটা মনে করে থাকেন, তাহলে তিনি খুব ভুল করবেন। ইউক্রেনের জনগণ যুদ্ধ করছেন। তাদের সংখ্যা অগণিত।

তাদের হাতে অস্ত্র আছে। তারা কঠোর লড়াই করছেন। তাদের মধ্যে আছেন স্কুলশিক্ষক, অফিসের কেরানি, গৃহবধু, আর্টিস্ট, শিক্ষার্থী, ডিজে, মাদকের সম্রাজ্ঞি। তারা সবাই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। তাদের এখন একটাই টার্গেট- রাশিয়ান সেনাদের গুলি করা। ইউক্রেন এক ইঞ্চি জায়গাও ছেড়ে দিচ্ছে না। এতে মনে হচ্ছে, ওইসব শহরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে না দেয়া পর্যন্ত, যেমনটা তিনি গ্রোজনি ও আলেপ্পোতে করেছিলেন, তেমনটা না করা পর্যন্ত- তা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবেন না পুতিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button