হারানো বস্তু উদ্ধারে পুলিশের আগ্রহ কম কেন?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : মেহনাজ ইসলাম বৃষ্টি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী। রাজধানীতে একটি আউটলেটে বিক্রকর্মী হিসেবে নিয়োজিত। এ বছরের মার্চ মাসে নিজের জমানো ২৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন কেনেন। তবে ফোনটি বেশি দিন ব্যবহার করতে পারেননি। গত ৩ এপ্রিল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে হারিয়ে যায় ফোনটি। অনেক খোঁজাখুজির পরও না পেয়ে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং-২৩৪) করেন ভুক্তভোগী। চার মাসেও ফোনটি উদ্ধার হয়নি। এ সম্পর্কে জিডি’র তদন্তভার পাওয়া উপ-পরিদর্শক (এসআই) টিটু সরদার কোনও খোঁজও দিতে পারেননি।

ভুক্তভোগী বৃষ্টি বলেন, ‘জিডি করার মাসখানেক পর তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগোযোগ করলে তিনি জানান, আপনার মোবাইল ফোনটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও ফোনের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) চেক করতে হবে, এতে কিছু খরচ লাগবে। আমি জানাই ফোনটি উদ্ধারের পর সমস্ত খরচ দিয়ে দেবো। এরপর তিনি আর কোনও খোঁজ দেননি।’

এ বিষয়ে জিডির তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) টিটু সরদারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি চেক করে দেখেছি, তার মোবাইলফোনটি আর অন হয়নি। যদি অন হয় তবে কল সিডিআর তুলে ট্রেস করা সম্ভব হবে। অপরদিকে কেউ যদি আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে ফেলে, সেক্ষেত্রে ফোন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।’ তিনি এও জানান, শাহবাগ থানা থেকে র‍্যাবে তার পোস্টিং হয়ে গেছে। তাই এ বিষয়ে আর কোনও খবর তার জানা নেই।

শুধু বৃষ্টি নয়, তার মতো অনেক ভুক্তভোগী রয়েছেন। মোবাইল ফোন হারানো নিয়ে জিডি করেছেন, কিন্তু হারানো ফোন উদ্ধার হয়নি। ছিনতাইয়ের শিকার, চুরি অথবা অচেতন মনে অনেকেরই শখের ফোনটি হারিয়ে যায়। রাজধানীর থানাগুলোতে প্রতিনিয়ত এ সংক্রান্ত বহু জিডি দায়ের হচ্ছে। তবে এসব জিডি’র ভিত্তিতে হারানো ফোন উদ্ধারের পরিমাণ খুবই কম। ভাগ্যক্রমে কয়েকজনের হারিয়ে যাওয়া ফোন উদ্ধার করা গেলেও অধিকাংশের ফোনই আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

হারানো সংক্রান্ত যে কোনও মামলা/জিডি ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য। তবে হারানো সংক্রান্ত জিডি অনুসন্ধান অথবা তদন্তে বেশিরভাগ পুলিশ কর্মকর্তাদের অনীহা রয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ফলে এ সংক্রান্ত জিডি থানায় শুধু নথিভুক্ত হিসেবেই থেকে যায়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, থানায় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ মূল্যবান বস্তু হারানো সংক্রান্ত জিডি প্রতিনিয়তই হচ্ছে। রাজধানীতে চুরি হওয়া, ছিনতাইকৃত অথবা হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন কেনার অনেক সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা এসব চোরাই মোবাইলফোনের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি) নম্বর পরিবর্তন করে ফেলে। এরপর সেগুলো আবার বিক্রি করে থাকে। এদিকে দামি ফোন বা ডিভাইস হলে সেগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাঠিয়ে দেয়। এতে করে হারিয়ে যাওয়া অনেক মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। কারণ আইএমইআই নম্বর কার্যকর থাকে না।’

হারানো মোবাইল ফোন সংক্রান্ত জিডি’র একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, একটি মোবাইল ফোনের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) বের করতে হলে কম্পিউটার অপারেটরকে টাকা দিতে হয়। নয়তো তারা কাজ করে না। আবার কোনও কোনও ফোনের একাধিক সিডিআর বের করতে হয়। যতবার সিডিআর বের করতে হয়, ততবারই তারা টাকা চায়। কিন্তু ভুক্তভোগীর কাছে তো টাকা চাওয়া যায় না। ফলে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করেই মোবাইলের সিডিআর তুলতে হয়। তাই পুলিশ সদস্যরা মোবাইল ফোন হারানো সংক্রান্ত জিডি তদন্ত করতে আগ্রহ কম দেখান।

‘মোবাইল ফোন উদ্ধার আর হত্যা মামলার তদন্ত এক সমান’

নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক পুলিশের উপ-পরিদর্শক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা, আর একটি হত্যা মামলার তদন্ত করা এক সমান। একদিকে, শারীরিক পরিশ্রম, অপরদিকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে দীর্ঘ সময় লেগে থাকতে হয়। মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে গেলে থানা-পুলিশের আর কোনও মামলার তদন্ত করা সম্ভব হয় না।’

এ বছরের পহেলা বৈশাখে (১৪ এপ্রিল) বন্ধুদের সঙ্গে রমনা পার্কে বেড়াতে গিয়েছিলেন শাকিল আহমেদ হৃদয়। পার্কের প্রবেশ গেটে দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল। সেখানে তার পকেট থেকে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনটি চুরি হয়। পরদিন রাজধানীর রমনা থানায় জিডি করেন তিনি। কিন্তু এই জিডি তদন্তে চার মাসে কোনও অগ্রগতি জানাতে পারেননি উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুনুর রশিদ।

ভুক্তভোগী শাকিল আহমেদ হৃদয় বলেন, ‘আমি থানায় জিডি করার পরপরই তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মামুনুর রশিদের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি বলি। তখন মোবাইল ফোনের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) চেক করে দেখার জন্য তাকে ৬০০ টাকা দিয়ে আসি। তিনি ১৫ দিন পর যোগাযোগ করতে বলেন। যথারীতি ১৫ দিন পর যোগাযোগ করলে জানান, এখনও কাজ হয়নি। এরপর আর খোঁজ-খবর দেননি তিনি।’

এ বিষয়ে রমনা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুনুর রশিদ বলেন, ‘হারানো ফোনের মালিক জিডি দায়েরের পর প্রথম কিছুদিন যোগাযোগ করেন। মাস পার হয়ে গেলে ভুক্তভোগীরা আর খবর নেন না। এতে আমরাও অন্য মামলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই নিয়মিত খোঁজ না নেওয়ার কারণে উদ্ধার সম্ভব হয় না।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘কোনও ব্যক্তির মূল্যবান কিছু হারিয়ে গেলে অথবা কোনও ক্ষতির সম্মুখিন হলে সাধারণত থানায় জিডি করেন। সাধারণত থানাগুলোতে মামলার বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। জিডিগুলোও গুরুত্বের ভিত্তিতে তদন্ত করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোন ছিনতাই হতে পারে অথবা হারিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেকেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে জিডি করে থাকেন। তবে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা করলে সেটি গুরুত্ব বেশি পায়। কিন্তু অধিকাংশই মামলায় জড়াতে চান না বলে হারানো জিডি করে আসেন। অনেক সময় যদি আমরা বুঝি যে, হারানো ওই বস্তু খুঁজে পাওয়া যাবে না তবে সেক্ষেত্রে সেটি গুরুত্ব দেওয়া হয় না।’

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button