অবৈধ পথে শতকোটির মালিক আওয়ামী আমলের ওসি কামাল

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গাজীপুর ও ময়মনসিংহের তিনটি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন ওসি কামাল হোসেন।
রাজবাড়ীর সন্তান কামাল হোসেনের নিজ জেলা ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, শেরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি, জমি, রিসোর্ট, মাছের খামার, সঞ্চয়পত্র ও একাধিক গাড়ি। সংশ্লিষ্টদের মতে, তার এই সম্পদের মূল্য শতকোটি টাকার ওপরে। স্ত্রী, কন্যা, ভাই, মা-বাবা ছাড়াও নামে-বেনামে এসব সম্পদ গড়েছেন তিনি।
রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার নগর বাথান গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান কামাল হোসেন ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে শেরপুর জেলায় যোগদানের মধ্য দিয়ে চাকরি জীবন শুরু করেন। পুলিশের এসআই হিসেবে পিএসআই পিরিয়ড অতিক্রম না করেই তার চেয়ে বেশি বয়সের এক বিধবা মহিলাকে দুই সন্তানসহ বিয়ে করেন কামাল হোসেন।
সেই বিধবা মহিলার স্বামী ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার আবুল কাশেম। বর্তমানে এই দম্পতি শত কোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন থানায় চাকরি করে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৫ সালে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগদান করেন গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানায়। এ সময় আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে।
অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নানাভাবে চাঁদাবাজি ও অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। গাজীপুরের এমসি গার্মেন্টস, মায়ের দোয়া রিয়েল এস্টেটের মালিক গাজীপুরের শিল্পপতি মো. কামরুজ্জামানসহ অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।
যেগুলো পরিচালনা করেন তার স্ত্রী উম্মে রোমান। ওসি কামাল তার ছোট ভাই ময়নুল ইসলামের নামেও ব্যবসা করে যাচ্ছেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব শেষ করে ২০২১ সালে ওসি হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহের ভালুকা থানায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তাকে বদলি করা হয় পার্শ্ববর্তী ত্রিশাল থানায়। ওই সময় তার বিরুদ্ধে নৌকার পক্ষে প্রচারণার অভিযোগ উঠে এবং নির্বাচন কমিশনে এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়। অভিযোগের পরও অদৃশ্য কারণে কামাল হোসেনের কিছু হয়নি।
জানা গেছে, ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় নিজের পছন্দমতো থানায় পোস্টিং নিয়ে যতদিন ইচ্ছা ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন কামাল হোসেন। মূলত গাজীপুরের টঙ্গী ও জিএমপির টঙ্গী পূর্ব থানা, ময়মনহিংহের ভালুকা ও ত্রিশাল থানায় চাকরি করেই তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হন।
বর্তমানে ওসি কামাল হোসেনের স্ত্রী উম্মে রোমানের নামে রাজধানী ঢাকার উত্তরার ৯নং সেক্টরে রয়েছে বিলাসবহুল একটি ৮ তলা বাড়ি। বাড়ি নির্মাণের অধিকাংশ সরঞ্জামাদি বিদেশ থেকে আনা। ঢাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট। কামাল হোসেনের নিজ জেলা রাজবাড়ীর নগর বাথানে ‘ঝিলিক মঞ্জিল’ নামে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি।
গাজীপুরের হোতাপাড়া ও মণিপুরে উম্মে রোমানের নামে রয়েছে কয়েক একর জমি। তার শ্বশুরবাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদীতে স্ত্রীর নামে, শেরপুর পৌরসভা সংলগ্ন গোপালবাড়িতে স্ত্রী, দুই সৎ মেয়ে কুমি ও কনকচাঁপার নামে এবং রাজবাড়ীতে ভাই ময়নুল ইসলাম ও মা-বাবার নামে কিনেছেন কয়েক কোটি টাকার জমি। বেনামে গাজীপুরে একটি রিসোর্টও পরিচালনা করছেন কামাল হোসেন।
ওসি কামাল হোসেন স্ত্রীর নামে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায় ৬ একর জায়গায় একটি মাছের খামার গড়ে তোলেন। মাছ চাষ না হলেও আয়কর ফাইল ভারী করার জন্য ওই খামারটিকে তিনি কাগজে-কলমে ব্যবহার করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওসি কামাল হোসেনের পরিবার একাধিক গাড়ি ব্যবহার করলেও গাড়িগুলোর নিবন্ধন একাধিক ব্যক্তির নামে। তার ছোট মেয়ে ঝিলিক চলাচল করেন প্রায় কোটি টাকা মূল্যের কালো রঙের একটি হ্যারিয়ার গাড়িতে, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৭-৫৭৬৬। স্ত্রী উম্মে রোমান চলাচল করেন এক্স করোলা ও টয়োটা ফিল্ডার গাড়িতে।
টয়োটা ফিল্ডার গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-২৮-৭২০৫। ওসি কামাল হোসেন তার সৎ মেয়ে কনকচাঁপার নামে শেরপুর জেলার প্রধান ডাকঘরে ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ৩০ লাখ টাকার এফডিআর কিনেন।
শেরপুরের আইএফআইসি ব্যাংকে ৩০ লাখ টাকার এফডিআর কিনেছেন। ওই ব্যাংকে টাকার উৎসের জায়গায় ওসি কামাল হোসেন তার শাশুড়ির নামে কেনা ৩৫ লাখ টাকার একটি সঞ্চয়পত্রের কাগজ দাখিল করেন। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি তার শাশুড়ির নামে কেনা সঞ্চয়পত্রের নম্বর গসপ-চ-০২৬৮৫১১-৫১৭ (সাতটি সঞ্চয়পত্র, যার প্রতিটির মূল্য ৫ লাখ টাকা)।
একজন ওসির স্ত্রী হয়ে উম্মে রোমান বছরে কয়েকবার সিঙ্গাপুর যান ঘুরতে ও চিকিৎসা করাতে। সিঙ্গাপুরের মালাবার থেকে কিনেছেন শত ভরির ওপর স্বর্ণালংকার। মেয়েরাও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। বর্তমানে তার মেয়ে কুমি বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর সারা দেশের পুলিশ সদস্যরা যখন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ, ঠিক সে সময়েও কামাল হোসেনের ফেসবুক ওয়ালে সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি ছিল। নানা অপকর্মে অভিযুক্ত পুলিশের এই কর্মকর্তা (বিপি ৭৭৯৯০৩৮৭৮৭) বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলার বঙ্গবন্ধু সেতু (পূর্ব) নৌফাঁড়িতে কর্মরত রয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব নৌফাঁড়ির আইসি ওসি কামাল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমার এক নিকটাত্মীয় আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ করে বেড়াচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নাই। আমি সব সময় সত্যের পথে চলার চেষ্টা করি।’ টাঙ্গাইল নৌপুলিশের এসপি সোহেল রানা খবরের কাগজকে বলেন, ‘যদি তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করেন বা আমরা পাই, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সূত্র : খবরের কাগজ